শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনশনরত শিক্ষার্থীদের ঘিরে এক সপ্তাহ ধরে যে উৎকণ্ঠার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তা কেটে গেছে বুধবার।
শিক্ষক থেকে শিক্ষামন্ত্রী পর্যন্ত অনেকে চেষ্টা করেও যখন শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙাতে পারছিলেন না তখন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল গিয়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেটি করেছেন।
শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে ভার্চুয়াল বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তাদের দাবিও তুলে ধরেন বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক এই অধ্যাপক।
শিক্ষার্থীরা জানান, তারা জাফর ইকবালের অনুরোধে অনশন ভাঙলেও, উপাচার্য পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে মন্ত্রীকে জানিয়েছেন।
দিনভর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাটিয়ে অধ্যাপক জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হক ঢাকা ফিরে গেছেন বুধবার সন্ধ্যায়।
উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন গত ১৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হলেও তিন দিন পর থেকে আমরণ অনশনে বসেন ২৪ জন। বাবার অসুস্থতার কারণে একজন বাড়ি চলে যান সেদিন। দফায় দফায় অনশনে যোগ দেন আরও ৫ শিক্ষার্থী।
গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় এদের মধ্যে ২০ জনকেই ভর্তি করা হয় হাসপাতালে, বাড়তে থাকে শঙ্কা আর উদ্বেগ। ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্ষোভও বাড়তে থাকে।
সহযোদ্ধাদের শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হতে দেখে মঙ্গলবার দুপুর থেকে অনশনের কর্মসূচি থেকে সরে আসার বিষয়ে আলাপ করতে থাকেন আন্দোলনকারীরা।
তবে অনশনকারীরা নিজেদের কর্মসূচিতে অনড় থাকেন।
এ নিয়ে আন্দোলনকারী ও অনশনকারীদের মধ্যে মঙ্গলবার গভীর রাত পর্যন্ত চলতে থাকে আলোচনা।
এরই মধ্যে বুধবার ভোর ৪টার দিকে ক্যাম্পাসে পৌঁছান জাফর ইাকবাল ও ইয়াসমিন হক। ক্যাম্পাসে তাদের পা পড়তেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন শিক্ষার্থীরা। সাবেক এই দুই অধ্যাপকও ধরে রাখতে পারেননি কান্না।
প্রিয় শিক্ষককে পাশে পেয়ে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ক্ষোভ ও শঙ্কার কথা খুলে বলেন।
জাফর ইকবাল অনশনকারীদের আশ্বস্ত করেন, তাদের সব দাবি মেনে নেয়া হবে বলে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশনা এসেছে। এই বার্তা নিয়ে তিনি ক্যাম্পাসে ছুটে এসেছেন। তিনি অনশন ভাঙার জন্য শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করেন।
ঘণ্টাদুয়েকের আলোচনা শেষে সকাল ৬টার দিকে শিক্ষার্থীরা অনশন ভাঙতে রাজি হন।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনশনরতদের ক্যাম্পাসে আনা হলে বুধবার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে প্রিয় দুই শিক্ষকের উপস্থিতিতে পানি পান করে একযোগে অনশন ভাঙেন ওই ২৮ জন।
দুই সপ্তাহ ধরে অস্থির ক্যাম্পাসে স্বস্তি নামে। অনশন ভেঙে শিক্ষকদম্পতিকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন শিক্ষার্থীরা। প্রিয় শিক্ষকদের তারা ফুল উপহার দেন, তোলেন ছবি।
বেলা প্রায় ১২ টায় দিকে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন হক।
জাফর ইকবাল বলেন, ‘এখানে আসার আগে আমার সঙ্গে সরকারের অনেক উচ্চমহল থেকে কথা বলেছে। আমি তাদের অনুরোধ করব, তারা আমাকে যে কথা দিয়েছেন সে কথাগুলো যেন রক্ষা করেন। আমি আর এই ছাত্রদের ভেতর কোনো পার্থক্য নাই।
‘আমাকে যে কথাটা দিয়েছেন তা যদি রক্ষা করা না হয়, তাহলে বুঝে নেব তারা শুধু ছাত্রদের সঙ্গে নয়, আমার সঙ্গে এবং এই দেশের যত প্রগতিশীল মানুষ আছে সবার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। কাজেই আমি আশা করব তারা যেন আমাকে যে কথা দিয়েছেন সে কথাগুলো রাখেন।’
উপাচার্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি যতটা চিন্তা করেছিলাম অনশনকারীদের শারীরিক অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। তাদের শরীরে স্যালাইনও পুশ করা যাচ্ছে না। বেশির ভাগই বসতে পারছে না। যে মানুষ এই অবস্থা দেখার পরও নিজের জায়গায় অনড় থাকে, তাকে আমি মানুষ বলতে চাই না। আমি তাকে দানব বলি।’
সংবাদ সম্মেলন শেষে জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন হক ফিরে যান বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স কোয়ার্টারে।
সেখানে মধ্যাহ্নভোজ ও বিশ্রাম শেষে বিকেলে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠকে বসেন জাফর ইকবাল। তাতে যুক্ত করেন আন্দোলনকারী কয়েক শিক্ষার্থীকে।
ওই বৈঠকে থাকা শিক্ষার্থী মোহাইমনুল বাশার রাজ নিউজবাংলাকে জানান, শিক্ষামন্ত্রী তাদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন। অনশনে যারা ছিলেন, তাদের স্বাস্থ্যের বিষয়েও খোঁজ নিয়েছেন।
রাজ জানান, তাদের পক্ষ থেকে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিসহ নানা অভিযোগ শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন জাফর ইকবাল। এ সময় শিক্ষামন্ত্রী তাদের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে বলে আশ্বস্ত করেন এবং আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিতে বলেন।
রাজ আরও জানান, অনশন ভাঙলেও তারা তাদের দাবি আদায়ে অনড়। উপাচার্য পদত্যাগ না করা পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
এই বৈঠক শেষে সন্ধ্যায় ঢাকার পথে রওনা হন জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন হক।
অধ্যাপকের ব্যক্তিগত সহকারী জয়নাল আবেদীন এই তথ্য জানিয়েছেন নিউজবাংলাকে।
শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙতে রাজি করানোয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে প্রশংসিত হচ্ছেন এই শিক্ষকদম্পতি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী জে এ সিদ্দিকী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আবারও একটি সূত্র প্রমাণিত হলো- সাস্ট ও সাস্টের ছাত্রছাত্রীরা মানেই জাফর স্যার।’
সাবেক আরেক শিক্ষার্থী শরিফুল ইসলাম লেখেন, ‘আবারও প্রমাণ হলো, জাফর স্যারই পারেন। সবাই যেখানে ব্যর্থ সেখানে জাফর স্যার সফল। একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কাছে কতোটা প্রিয় আর শ্রদ্ধেয় হতে পারেন সেটিও প্রমাণ হলো আজ।’