দেশে করোনাভাইরাসের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি আরও দুই সপ্তাহ চলবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এই সময়ে সংক্রমণের বিবেচনায় অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে যাবে। এরপর ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসবে সংক্রমণের হার।
দেশে দুই বছর ধরে জিন পরিবর্তন করে একাধিক নামে ও রূপে এসেছে করোনাভাইরাস। এবার ডেল্টা ও ওমিক্রনের একযোগে সংক্রমণের ফলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সংক্রমণরোধে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
তবে মাঠপর্যায়ে প্রশাসনের তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। সরকারের নেয়া উদ্যোগ তেমন কাজে আসছে না। এতে সার্বিকভাবে করোনা নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। এরই মধ্যে দিনে করোনা শনাক্ত ১৬ হাজার ছাড়িয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের সংবাদ দেয় অধিদপ্তর। ওই বছরের শেষ দিকে সংক্রমণের প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসে। গত বছরের এপ্রিল থেকে জুন-জুলাই পর্যন্ত করোনার ডেল্টা ধরন ব্যাপক আকার ধারণ করে। এর প্রভাবে দ্বিতীয় ঢেউ আসে।
বছরের শেষ কয়েক মাস পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল ছিল। কিন্তু এ বছরের শুরু থেকে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে করোনার বিস্তার আবারও বাড়তে শুরু করে। এতে করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে।
এখন ঘরে-বাইরে অবস্থানকারী সব ধরনের মানুষের শরীরে ভাইরাসটি শনাক্ত হচ্ছে। এর পরও হাট-বাজার, মেলা, বাস-ট্রেন কোনোখানেই কোনো ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, সর্বশেষ বুধবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৪৯ হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা করে ১৫ হাজার ৫২৭ জনের মধ্যে সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এ সময় আরও ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে মোট করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১৭ লাখ ৩১ হাজার ৫২৪ জনে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে ২৮ হাজার ২৭৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের তেমন প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। এই মুহূর্তে শুধু টিকা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আর হাসপাতাল প্রস্তুতির কথা বলছে। আসলে সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
যদিও এই স্বাস্থ্যবিধি মানানোর দায়িত্ব সরকারের একার নয়, এর সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করা জরুরি। কিন্তু সরকার নির্দেশনা দিলেও প্রশাসনের তেমন তৎপরতা নেই।
সংক্রমণ আরও কিছুদিন বাড়বে জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতি চলবে আরও দুই সপ্তাহ। এরপর এক সপ্তাহ সমান্তরাল থাকবে। তারপর নিম্নমুখী হবে সংক্রমণ।’
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগ এবং সাধারণ মানুষ কী করবে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মানুষের উচিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। সঠিক নিয়ম মেনে মাস্ক পরা। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারিভাবে হাসপাতাল প্রস্তুত রাখতে হবে। টিকা কার্যক্রমে গতি বাড়াতে হবে।
হাসপাতালে রোগীদের অক্সিজেন নিশ্চিত করতে হবে। নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে দৈনিক টেস্টের সংখ্যা অবশ্যই এক লাখ হলে ভালো হতো। টেস্ট কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে জনবল নিয়োগ দিতে হবে।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, ‘বাংলাদেশে ওমিক্রন প্রথম শনাক্তের ঘোষণা আসে ১১ ডিসেম্বর। ওই মাসেই আইসিডিডিআরবির ল্যাবে পরীক্ষা করা শুধু ঢাকা শহরের ৭৭ জন করোনা রোগীর মধ্যে পাঁচজনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্ত করা হয়েছিল। অন্যরা ছিলেন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। এর পর থেকে দুই ধরনের আধিপত্য ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। সংক্রমণ পরিস্থিতি ফের উদ্বেগ ছড়াচ্ছে।
ওমিক্রন দাপটের মধ্যে রেকর্ডসংখ্যক রোগী বাড়তে থাকায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) একটি গবেষণা পরিচালনা করে। সেখানে বলা হয়, খোদ ঢাকা শহরেই করোনার তিনটি সাব-টাইপ রয়েছে। গবেষণায় পরীক্ষিত নমুনার মধ্যে ২৮ শতাংশ করোনায় আক্রান্ত। আর আক্রান্তদের মধ্যে ওমিক্রন ছিল ৬৯ শতাংশের দেহে।
অন্যদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি করোনা রোগীদের ৮৫ শতাংশই টিকা নেননি। এমনকি করোনায় মারা যাওয়াদের বেশির ভাগেরও টিকা নেয়া ছিল না। ইতোমধ্যে সরকারি হাসপাতালের ২৫ শতাংশ শয্যায় রোগী ভর্তি রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের সামাজিক সংক্রমণ ঘটেছে। উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসা ৮০ শতাংশই পজিটিভ আসছে। যাদের বেশির ভাগই করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনে আক্রান্ত। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয় যে প্রস্তুতি নিলেও তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
সরকারের রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট রোগতত্ত্ববিদ ড. মুশতাক হোসেন বলেন, সারা বিশ্বেই ওমিক্রনের প্রভাবে করোনা শনাক্তের সব রেকর্ড ভেঙে গেছে। বাংলাদেশেও দু-এক দিনের মধ্যে শনাক্তের আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।
নমুনা পরীক্ষা বাড়ানো গেলে আক্রান্ত ও শনাক্তের হার আরও বাড়বে। যারা আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসা সুবিধা বাড়াতে হবে। পরীক্ষা করার সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, এখন ৫০ হাজার নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। সেখানে ১৫ হাজার শনাক্ত হচ্ছে। ১ লাখ ৫০ থেকে ১ লাখ ৬০ হাজার রোগী শনাক্ত হবে। করোনা আক্রান্তদের সরকার ফলোআপের ব্যবস্থার আওতায় আনবে। মেডিসিনের মাধ্যমে অসুস্থদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা। সুনির্দিষ্টভাবে আইসোলেশন সেন্টার করতে হবে, যেখানে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
যেসব স্থানে মানুষের উপচেপড়া ভিড় হচ্ছে, সেখানে করোনা টেস্টের ব্যবস্থা রাখা উচিত। যেমন বাণিজ্য মেলা, গণপরিবহন, শপিংমল। এসব জায়গায় বিনা মূল্যে অ্যান্টিজেন টেস্ট করতে হবে। আধা ঘণ্টার মধ্যেই ফলাফল নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে মানুষ আগ্রহী হবে। যেটা করোনা মোকাবিলায় করণীয় নির্ণয়ে সহায়ক হবে।