শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে তীব্র আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৩ বছরে শিক্ষার্থী আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেছেন পাঁচজন উপাচার্য। এমন পরিস্থিতিতে উপাচার্য নিয়োগে সরকারকে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন শিক্ষাবিদরা।
তারা বলছেন, উপাচার্য নিয়োগে সার্চ কমিটি অথবা বিশেষজ্ঞ প্যানেল করা যেতে পারে। তারা যাচাই-বাছাই করে যোগ্য ব্যক্তিদের উপাচার্য নিয়োগের সুপারিশ করবে। নিয়োগপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিতের পরামর্শও দিচ্ছেন শিক্ষাবিদরা।
২০০৯ সালে পদত্যাগ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম এ ফায়েজ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির পদত্যাগ করেন ২০১২ সালে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেনও পদ ছাড়তে বাধ্য হন ২০১৪ সালে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসির উদ্দিন আহমেদ ২০১৯ সালে এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এম ইমামুল হক একই বছর পদত্যাগ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকার যোগ্য লোককে যোগ্য জায়গায় বসাতে পারছে না বলেই উপাচার্যদের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।’
তার মতে, ‘আচার্য মানেই হচ্ছেন প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী। উপাচার্যরা তার সমগোত্রীয়। তাই উপাচার্য নিয়োগ যাচ্ছেতাইভাবে হতে পারে না।’
এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘সার্চ কমিটির মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে। এ রীতি আমাদের পাশের দেশ ভারতেই আছে। এ পদ্ধতি অবলম্বন করলে যোগ্য ব্যক্তিরা সঠিক জায়গায় অধিষ্ঠিত হবেন।’
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
একই ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘পদের মোহে অনেকেই উপাচার্য পদে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছেন, যা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য সুখকর নয়। এ জন্য উপাচার্য নিয়োগপ্রক্রিয়া খুব স্বচ্ছ হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ প্যানেল করা যেতে পারে। তারা দেখে উপাচার্য নিয়োগের সুপারিশ করবে।
উপাচার্য হিসেবে যারা নিয়োগ পান তাদের মেয়াদ একবারের বেশি হওয়া উচিত নয় বলেও মনে করছেন অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘তা না হলে যারা উপাচার্য পদে নিয়োগ পেতে ব্যর্থ হন তারা বিভিন্ন ঘটনায় ইন্ধন জোগান।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েকটি কারণে উপাচার্যদের বিরুদ্ধে নানা সময়ে অভিযোগ ওঠে। এর মূলে রয়েছে অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্য ও শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে। এগুলো ক্ষতি করেছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে।’
তার মতে, ‘বিভিন্ন কারণে উপাচার্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। এর পেছনে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতি। এ ছাড়া বড় বড় কাজের টেন্ডার তো রয়েছেই। কারও (উপাচার্য) বিরুদ্ধে সত্যিকার অর্থে অভিযোগ উঠলে ইউজিসি দেশের গণমান্য শিক্ষাবিদদের নিয়ে একটা প্যানেল করতে পারে। সেই প্যানেল অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থার সুপারিশ করবে।’
উপাচার্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠা ‘অস্বাভাবিক নয়’ বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উপাচার্যদের বিরুদ্ধে অনেক ধরনের অভিযোগ উঠতেই পারে। তবে সব অভিযোগ সত্য নয়। অভিযোগগুলোর মধ্যে দুটি গুরুতর। একটি হচ্ছে নৈতিক স্খলন, আরেকটি দুর্নীতি। এর একটিও যদি কারও বিরুদ্ধে ওঠে, অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে তা তদন্ত করতে হবে। যা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি করে থাকে। তদন্ত করে অভিযোগ প্রমাণিত হলে অবশ্যই দায়ীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।’
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের দেয়াল লিখন
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান আন্দোলনের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘সেখানে কিন্তু ফরিদের (শাবি উপাচার্য) বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলন বা আর্থিক দুর্নীতির কোনো অভিযোগ নেই। অদক্ষতা বা অযোগ্যতা সেগুলো অন্য বিষয়। তারপরও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে।’
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতার অন্যতম কারণ আঞ্চলিকতা বলে মনে করছেন সাবেক শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান (এন আই খান)।
তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে লোকাল ছেলেমেয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছে। নিয়োগ পেয়েই তারা একটি বলয় সৃষ্টি করে। আমেরিকায় কিন্তু যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আপনি পাস করবেন সেখানে প্রথমে শিক্ষক হওয়া যায় না। প্রথমে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে হবে। এরপর সেখানে শিক্ষকতায় নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে সে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে সেখানে নিয়োগের সুযোগ পাবে। এ জন্য আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেন ভারসাম্য থাকে সে ব্যবস্থা করতে হবে।’
উপাচার্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মনে করেন এই সাবেক শিক্ষাসচিব।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আছে, প্রশাসনে যারা থাকে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে ন্যায়-অন্যায় যা-ই হোক তাদের সরিয়ে দিতে হবে। এটাই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। যারা উপাচার্য তারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তাই পদ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যেন কলুষিত না হয় সে বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।’
ড. জাফর ইকবালের অনুরোধে অনশন ভেঙেছেন শাবি শিক্ষার্থীরা
অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক মনে করছেন, কোনো উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে নৈতিক অবস্থান থেকে সে বিষয়ে তার নিজেরই পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উপাচার্যের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে বিশ্ববিদ্যালয়-কাঠামোর মধ্যেই এর সমাধান আছে। যেমন, সিনেট ও সিন্ডিকেট। এ দুটোতেই সভাপতিত্ব করেন উপাচার্য। তাই উপাচার্যরা যখন দেখবেন তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এসেছে, তখন তিনি নৈতিক অবস্থান থেকে সেখানে আর সভাপতিত্ব করবেন না।
‘তা যদি তিনি না করেন তাহলে উচিত ইউজিসিতে অভিযোগগুলো তদন্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ যাওয়া। এটাই নিয়ম ও বিধিবিধান। এ ছাড়া উপাচার্য স্বপ্রণোদিত হয়েও ইউজিসিকে তদন্তের অনুরোধ করতে পারেন।’
অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘আমি মনে করি নৈতিক অবস্থান থেকে উপাচার্যদের উচিত তার বিষয়ে যে অভিযোগগুলো এসেছে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইউজিসি গঠন করেছিলেন যাতে শিক্ষকদের ওপর অন্যরা কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ না করতে পারে। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন শিক্ষকদের স্বশাসনের ওপর।’
উপাচার্য নিয়োগে আরও সতর্ক হতে সরকারকে পরামর্শ দেন এই শিক্ষাবিদ।
তিনি বলেন, ‘বর্তমান সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ জন্য আমি মনে করি নিয়োগপ্রক্রিয়ায় আরও সতর্ক হতে হবে।’