আট বছর আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস বিভাগকে ‘কাগজবিহীন’ বা পেপারলেস করার ঘোষণা দিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তাতে ব্যবসায়ীরা হয়রানিমুক্ত পরিবেশে ও কম সময়ে রপ্তানিপণ্য খালাস করতে পারবেন।
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাশের ভারতসহ বিশ্বের ৯০টি দেশে কাস্টমস বিভাগের পণ্যের অ্যাসেসমেন্ট থেকে শুরু করে শুল্কায়নের সব কার্যক্রম কাগজ ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ অনেক দিন ধরে এ উদ্যোগ নিলেও তার বাস্তবায়ন দৃশ্যমান হয়নি এখনও। কাস্টমস বিভাগের অধীনে দেশের কাস্টমস হাউস ও শুল্ক স্টেশনগুলো চলছে প্রচলিত প্রথায় ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে।
ব্যবসায়ীরা বলেছেন, শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সহজীকরণ হচ্ছে, তবে ধীরগতিতে। এখনও ব্যবসায়ীদের হয়রানির শিকার হতে হয়, বিশেষ করে পণ্যের শ্রেণীকরণ বা এইচএস কোড নিয়ে।
যোগাযোগ করা হলে ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ নিউজবাংলাকে বলেন, পণ্যটি কোন শ্রেণির, তা নির্ধারণ নিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমদানিকারকের প্রায়ই বাগবিতণ্ডা হয়। এতে করে পণ্য খালাসে কালক্ষেপণ হয়। এই জটিলতা নিরসন হওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি। এনবিআরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, একটি কাস্টমস হাউসে গড়ে দৈনিক তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার নথি ব্যবহার করা হয়।
সব কাস্টম হাউস পুরোপুরি অটোমেটেড বা স্বয়ংক্রিয় হলে কাগজের কোনো ফাইল থাকবে না। এতে করে পণ্য খালাসের সময় বাঁচবে। কমবে দুর্নীতি। গতিশীল হবে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য।
বর্তমানে এনবিআরের অধীনে চট্টগ্রামসহ বড় কাস্টম হাউস রয়েছে ছয়টি। আর ছোট শুল্ক স্টেশন ১৮৪টি। এর মধ্যে সক্রিয় শুল্ক স্টেশনের সংখ্যা ৩৭টি।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, কমলাপুর আইসিডি ও ঢাকা কাস্টম হাউস আংশিক অটোমেটেড চালু হলেও বাকিগুলো এর বাইরে এখনও।
নথি ব্যবহার করে এসব শুল্ক স্টেশনে পণ্য খালাস করার ফলে একদিকে বিপুল পরিমাণ শুল্ক ফাঁকি হচ্ছে, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অহরহ হয়রানির অভিযোগ উঠছে।
এ বাস্তবতায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বুধবার ২৬ জানুয়ারি পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক কাস্টমস দিবস, ২০২২।
১৯৫৩ সালে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে কাস্টমস কো-অপারেশন কাউন্সিলের উদ্বোধনী অধিবেশনকে স্মরণ করে প্রতি বছর এ দিনটি আন্তর্জাতিক কাস্টমস দিবস হিসেবে পালন করা হয়। পৃষ্ঠপোষকতা করে ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশন বা ডব্লিউসিও। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও ২০১০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক কাস্টমস দিবস পালন করে আসছে এনবিআর।
রাজস্ব আহরণে কাস্টমস বা আমদানি শুল্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে এনবিআরের মাধ্যমে আহরিত মোট রাজস্বে আমদানি শুল্কের অবদান ২৯ শতাংশ।
যদিও এই শুল্কের হিস্যা বা অংশ ধীরে ধীরে কমছে। তার জায়গা দখল করে নিচ্ছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের অন্যতম দুটি উৎস আয়কর এবং মূল্য সংযোজন কর– ভ্যাট।
তবে বর্তমানযুগে কাস্টমসের ভূমিকা রাজস্ব আহরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দেশের সার্বিক নিরাপত্তা অর্থনৈতিক গতিশীলতা রক্ষা করা এবং সামাজিক সুরক্ষার মধ্য দিয়ে কাস্টমসের উপস্থিতি স্বীকৃতি পেয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমনসহ অর্থের অবৈধ প্রবাহ রোধে বাংলাদেশ কাস্টমস সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ কাস্টমস বিভাগকে আধুনিকায়ন করার লক্ষ্যে ২০১৪ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সব কাস্টম হাউসের কর্মকাণ্ডকে কাগজবিহীন করার উদ্যোগ নেয়। এর অংশ হিসেবে ওই বছরের জুলাই মাসে দেশের সবচেয়ে বড় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় অটোমেটেড সিস্টেম ফর কাস্টমস ডাটা (অ্যাসাইকুডা) ওয়ার্ল্ড প্লাস চালু করা হয়।
পরে কাস্টম হাউস ঢাকা, কমলাপুর (আইসিডি) কাস্টম হাউসে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড প্লাস চালু করা হয়।
জাতিসংঘের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের সহযোগিতায় বাস্তবায়িত এ ব্যবস্থায় বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত সব কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয়।
রাজস্ব বোর্ডের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, আমদানি করা পণ্যের ১০০ চালানের মধ্যে অন্তত ৪০ শতাংশ মিথ্যা ঘোষণা (পণ্যের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম মূল্য) দেয়া হয়।
এ কারণে প্রতি বছর সরকার কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারায়। কাস্টমসের আধুনিকায়ন সম্পন্ন হলে পণ্য আমদানিতে ‘ওভার ইনভয়েসিং’ কমবে। এতে করে দেশ থেকে মুদ্রাপাচার রোধ করা যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদউদ্দিন বলেন, ‘কাস্টমস বিভাগে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন সম্পন্ন হলে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য আরও গতিশীল হবে। শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আসবে। এতে করে ব্যবসার খরচ ও সময় দুটিই কমবে। বাড়বে শুল্ক আদায়। কমবে অর্থপাচার।’
কাস্টমসের আধুনিকায়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ২০১৮ সালে দীর্ঘমেয়াদি স্ট্র্যাটেজিক অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করে।
এ পরিকল্পনার আওতায় পণ্যের শুল্কায়নে কর্মকর্তাদের সর্বনিম্ন হস্তক্ষেপ, মালামাল দ্রুত খালাসের মাধ্যমে বাণিজ্য সহজীকরণ নিশ্চিত করা, ন্যায়সংগতভাবে শুল্ক আদায়, দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করাসহ ১০টি পরিমণ্ডলে কর্মপন্থার খসড়া প্রণয়ন করা হয়। এ সব কর্মপরিকল্পনা শুধু কাগজেই সীমাবদ্ধ।
এ ছাড়া নতুন কাস্টমস আইনের খসড়ায় নানামুখী সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। সবচেয়ে বড় সংস্কার হচ্ছে কাস্টমসের সেবা সহজ করতে ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ড বা ওয়ান স্টপ সার্ভিস কর্মসূচি নেয়া হয়, যা ২০২২ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কিছু সংস্কার কার্যক্রম চালু হলেও বেশির ভাগই অগ্রগতি হয়নি।