পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের শ্যামপুর সুগার মিল এক বছরের বেশি সময় ধরে উৎপাদনে নেই। অথচ এ সময়েই সর্বোচ্চ দরে লেনদেন হয়েছে কোম্পানিটির শেয়ার।
কারখানার করুণ অবস্থাতেও শেয়ারের প্রতি আগ্রহ দেখা গেছে বিনিয়োগকারীদের। সুগার মিলের উৎপাদন বন্ধ থাকার সংবাদ জেনেও বেশি দরে শেয়ার কেনার প্রবণতা জন্ম দিয়েছে নানা প্রশ্নের। শেয়ারের চলতি দর নিয়েও বিস্মিত কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি মালিকানাধীন এ কারখানার যন্ত্রপাতি, লোকবল সরিয়ে নেয়া হচ্ছে অন্য মিলগুলোতে। বদলির অপেক্ষায় অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এই সময়েই সর্বোচ্চ দরে লেনদেন হয়েছে কোম্পানিটির শেয়ার। বন্ধ মিলের ভেতরে বাড়ছে আগাছা, পরিত্যক্ত পড়ে আছে অব্যবহৃত যানবাহন। বকেয়া বেতন আদায়ে মাঝে মাঝে আন্দোলন করেন কারখানার অবশিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর বন্দরে ১৯৬৪ সালে নির্মাণ হয় শ্যামপুর সুগার মিল। ছবি: নিউজবাংলা
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ওয়েবসাইটে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সুগার মিলটির উৎপাদন বন্ধের একটি নোটিশ দেয়া হয়। বলা হয়, কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুসারে ২০২০-২১ সালের জন্য আখ প্রক্রিয়াজাতকরণ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
খারাপ অবস্থাতেই তখন ১৪১ টাকায় উঠেছিল শ্যামপুর সুগার মিলের শেয়ার দর। যদিও ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এই সর্বোচ্চ দরের পর আর উত্থান হয়নি। এখন ক্রমাগত কমছে শেয়ার দর। সর্বশেষ মঙ্গলবার প্রতিটি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৭৫ টাকায়।
শেয়ার দর নিয়ে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহসান হাবিব নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোম্পানির উৎপাদন বর্তমানে পুরোদমে বন্ধ। তারপরও ৭৫ টাকা শেয়ার দর কীভাবে হয়?
‘সুগার মিলের উৎপাদন অনেক আগে থেকেই বন্ধ। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে কারখানার কার্যক্রম একেবারে নেই বললেই চলে। বর্তমানে কর্মচারী, কর্মকর্তাসহ ৪৪৩ জন কাজ করছেন। তাদের মধ্যে ১০৬ জন কারখানায় কর্মরত। অন্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বদলি করে জয়পুরহাট ও ঠাকুরগাঁওয়ের সুগার মিলে পাঠানো হয়েছে। কারখানার অব্যবহৃত ট্রাক, ট্রাক্টরসহ অন্যান্য যানবাহন আশপাশের কারখানায় পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।’
সুগার মিলটির ক্রান্তিকালের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে আখ মাড়াই বন্ধ ঘোষণার পর ৮ মাস এখানে কারও বেতন হয়নি। অন্য কারখানায় পদ না থাকায় সেখানে বদলিও করা যাচ্ছে না। ফলে যারা এখানে কর্মরত তারা পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।’
মিল কর্তৃপক্ষ জানায়, পুঁজিবাজারে ১৯৯৬ সালে তালিকাভুক্ত শ্যামপুর সুগার মিল এখন বন্ধ থাকলেও তা আধুনিকায়ন করে ফের চালুর কথা বলছেন সরকারের অনেকে। এমনকি মিলের নিজস্ব জায়গায় আলুর কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ, কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানা স্থাপন, ফিলিং স্টেশন ও এলপি গ্যাস স্টেশন নির্মাণ, মিনারেল ওয়াটার প্ল্যান্ট স্থাপন, বিনোদন কেন্দ্র ও রিসোর্ট নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রস্তাব বিবেচনাধীন।
শেয়ার মার্কেট পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কোম্পানিটির গত বছর প্রথম প্রান্তিকে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে শেয়ার প্রতি লোকসান হয়েছে ২১ টাকা ৬২ পয়সা। তার আগের বছর একই সময়ে লোকসান ছিল ২৫ টাকা ১৫ পয়সা।
সুগার মিলটির সম্পদের বিপরীতে শেয়ারের দায় ১ হাজার ১৩৬ টাকা। আগের বছর জুলাই-সেপ্টেম্বরে দায় ছিল ১ হাজার ১১৪ টাকা।
কোম্পানিটির মোট শেয়ারের ৫১ শতাংশ আছে সরকারের হাতে। আর ১ দশমিক ৯৩ শতাংশ শেয়ার আছে প্রাতিষ্ঠানিক। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে ৪৭ দশমিক ০৭ শতাংশ শেয়ার।
কারখানার অব্যবহৃত ট্রাক, ট্রাক্টরসহ অন্যান্য যানবাহন দীর্ঘদিনের অবহেলায় অচলপ্রায়। ছবি: নিউজবাংলা
রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর বন্দরে ১৯৬৪ সালে নির্মাণ হয় শ্যামপুর সুগার মিল। ১১১ দশমিক ৪৫ একর জমির ওপর নির্মিত এই মিলে আনুষ্ঠানিকভাবে মাড়াই শুরু হয় ১৯৬৭ সালে।
কারখানাটিতে দৈনিক আখ মাড়াইয়ের সক্ষমতা রাখা হয় ১ হাজার ১৬ টন। বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ধরা হয় ১০ হাজার ১৬১ টন। বছরে মিলের মেশিন চালু থাকে তিন মাস।
চালুর পর লাভের মুখ দেখলেও ২০০০ সালের পর থেকে টানা লোকসানের মুখে পড়ে মিলটি। প্রায় চার শ’ কোটি টাকা লোকসানের মুখে গত বছর মিলটি বন্ধ করে দেয় সরকার। দীর্ঘ সময় উৎপাদন বন্ধ থাকায় চিনিকলের যন্ত্রপাতি প্রায় নষ্টের উপক্রম। বিকল হয়ে পড়ে আছে আখ পরিবহনে ব্যবহৃত ট্রাক্টরগুলো।