ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলে অতিথি কক্ষে সোমবার রাত সাড়ে ১০টার চিত্র। সালাম না দেয়াসহ নানা অভিযোগে প্রথম বর্ষের একদল শিক্ষার্থীকে শাসাচ্ছে দ্বিতীয় বর্ষের কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী। হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুল বাছিরকে ফোনে বিষয়টি জানানো হলো। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, অসুবিধা নেই। নতুন শিক্ষার্থী যারা...।’
এটুকু বলেই চুপ হয়ে যান প্রাধ্যক্ষ আবদুল বাছির। বিষয়টি দেখবেন কি না ফের জিজ্ঞেস করলে এবার তিনি বলেন, ‘তুমি বলছো…। দেখি আমি, গেটে কী অবস্থা।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর অতিথি কক্ষে ‘আদব-কায়দা’ শেখানোর নামে মানসিক নিপীড়নকে (কখনো কখনো শারীরিকও) বলা হয় ‘গেস্টরুম’ সংস্কৃতি। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সক্রিয় কর্মীরা প্রথম বর্ষের সাধারণ শিক্ষার্থীদের এমন গেস্টরুম সংস্কৃতির মধ্যে রাখেন।
বিজয় একাত্তর হলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার চারটি গ্রুপ আছে। এই চার গ্রুপের প্রতিটির অনুসারীরা সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে তাদের গ্রুপে থাকা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গেস্টরুম সংস্কৃতির সবক দেয়।
বিজয় একাত্তর হলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতার চারটি গ্রুপ আছে। এই চার গ্রুপের প্রতিটির অনুসারীরা সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে তাদের গ্রুপে থাকা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গেস্টরুম সংস্কৃতির সবক দেয়।
এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাসের অনুসারী ও হল ছাত্রলীগে শীর্ষ পদপ্রত্যাশী সজিবুর রহমানের গ্রুপ গেস্টরুম সংস্কৃতির ‘ক্লাস’ নেয় সপ্তাহে তিনদিন।
সোমবার ছিল তিনদিনের একদিন। রাত ৯টা ২০ মিনিটে অতিথি কক্ষে শুরু হয় এই গেস্টরুম সংস্কৃতি। শেষ হয় সাড়ে ১১টায়।
গেস্টরুমে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রলীগ কর্মী। সামনে উপস্থিত ছিলেন সদ্য ক্যাম্পাসে আসা প্রথম বর্ষের ২০ শিক্ষার্থী।
নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে কয়েকজনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন- মারুফ, সজিব, মাশফি, নাইম ও মাযহার।
প্রথমেই জেরা করা হয় গেস্টরুমে নির্ধারিত সময়ে না আসা কয়েকজনকে। এরপর কারা কারা ভাইদেরকে সালাম দেয়নি তা নিয়ে শাসানো হয়। শিক্ষার্থীদের এমন জোরে শাসানো হচ্ছে যেটির আওয়াজ একশ’ ফুট দূরে হল গেট থেকেও শোনা যাচ্ছিল। যেগুলোর অডিও রেকর্ড নিউজবাংলার হাতে আছে।
সোমবার রাতে গেস্টরুমে কী হয়েছিল তা জানার জন্য গেস্টরুমে উপস্থিত থাকা প্রথম বর্ষের তিন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। নির্যাতনের শিকার হওয়ার শঙ্কায় তারা নাম বলতে রাজি হননি। তবে তাদের অডিও রেকর্ড নিউজবাংলার হাতে আছে।
এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘যারা বড় ভাইদের সালাম দেয়নি তাদেরকে বকা দেয়া হচ্ছিল। ভুলক্রমে আমিও এক ভাইকে সালাম দেইনি। আমাকে সামনে ডেকে যাচ্ছেতাই বকে যাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে কিছু ভাই খারাপ ভাষায় গালাগালও করছিল। এমন জোরে শাসানো হচ্ছিল যে আমার মাথাব্যথা শুরু হয়। তবে এসব গালাগাল শুনে কিছুদিন আগ পর্যন্ত খারাপ লাগলেও এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কারণ বুঝতে পারছি, এগুলো মেনে নিয়েই হলে থাকতে হবে।’
এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা ইচ্ছে করে সালাম দেই না তা তো না। ভুলে দেয়া হয় না। কিন্তু এটা নিয়েই প্রতিদিন আমাদের গালি শুনতে হয়।’
‘তুমি যদি মনে করো গেস্টরুমে শাসানো হচ্ছে তাহলে তুমি সেটা দেখছো না কেন? এখন প্রভোস্ট গিয়ে কি সেখানে হাজির হবে? একজন প্রভোস্ট তো সেখানে দৌড়ায়ে যাবে না।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গেস্টরুমে উপস্থিত থাকা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রলীগ কর্মী মারুফ বলেন, ‘আমি গেস্টরুমে এসেছি পরে। তবে এরকম কিছু হয়েছে কি না আমার মনে পড়ছে না।’
আরেক ছাত্রলীগ কর্মী নাইমকে ফোন দিলে তিনি বলেন, ‘এরকম কিছু হয়নি। আমরা গান-বাজনা করছিলাম।’
সজিব, মাশফি ও মাযহারকে ফোন দেয়া হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি।
এদিকে সোমবার রাতে ‘গেস্টরুম সংস্কৃতি’ চলাকালে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক আবদুল বাছিরকে ফোন দেয়া হলে তিনি বলেন, ‘তুমি যদি মনে করো গেস্টরুমে শাসানো হচ্ছে তাহলে তুমি সেটা দেখছো না কেন? এখন প্রভোস্ট গিয়ে কি সেখানে হাজির হবে? আমাকে তো হাউজ টিউটরদের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। একজন প্রভোস্ট তো সেখানে দৌড়ায়ে যাবে না।’
করোনা পরিস্থিতিতে ‘গেস্টরুম সংস্কৃতি’ চালু থাকলে অতিথি কক্ষে অপ্রয়োজনীয় ভিড় হবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এটি বন্ধ করার কএনা পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে এই প্রাধ্যক্ষ বলেন, ‘যারা কর্মী নিয়ে চলে তাদের ব্যাপারটা আলাদা। যাদের অর্গানাইজেশন তারা এটি বুঝবে। আমরা বুঝালে ওরা বুঝবে?
‘প্রশাসনের দায়িত্বে আছি বলে তো আমি সেখানে গিয়ে একটা অর্গানাইজেশনের কর্মসূচিতে বাধা দিতে পারি না। আমরা শুধু তাদের বলতে পারি- স্বাস্থ্যবিধি মেনে তোমরা কাজগুলো করো।’