বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

পাখিদের স্বর্গরাজ্য অরুনিমা

  •    
  • ২৫ জানুয়ারি, ২০২২ ১০:৩৯

দল দলে এক রঙের পাখি আকাশে উড়ে বেড়ায়। অনেক দল অরুনিমার লেকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোতে বসে ডানা ঝাপটায়। সুরে সুরে অতিথি পাখিগুলো জানান দেয়, সাত সাগর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে অরুনিমার এসে সুখেই আছে তারা।

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় নাম জানা, না জানা অসংখ্য পাখির কলরব। চারদিকে শুধু পাখি আর পাখি। হাজার হাজার পাখির কিচিরমিচির শব্দ আর ডানামেলার দৃশ্য মুগ্ধ করবে যে কাউকেই। গাছের ছায়ায়, পাখির মায়ায় আবেগে আপ্লুত হবেন সবাই।

এমনই দৃশ্য নড়াইল জেলায় অরুনিমা ইকোপার্কে। দেশের একমাত্র এগ্রো-ইকো-রিভারাইন-স্পোর্টস পর্যটনকেন্দ্র যেন এখন পাখিদের স্বর্গরাজ্য। বরাবরের মতো এবারের শীতেও এই পর্যটনকেন্দ্রে বেড়াতে এসেছে অতিথি পাখি। এসব পাখির সঙ্গে দেশি পাখির মিতালি যেন বন্ধুত্বপরায়ণ বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি।

অরুনিমার আশপাশের গ্রামগুলোও এখন পাখিগ্রামে পরিণত হয়েছে। বিশাল এলাকা এখন পাখির নিরাপদ অভয়াশ্রম। সেখানকার দৃশ্যটা এখন এমন যে, যত দূর চোখ যায় শুধু পাখিদের ওড়াউড়ি। স্থানীয়রা বললেন, এমনটা হয়ে আসছে গত এক যুগ ধরে।

সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অরুনিমার নীড় ছেড়ে খাবারের সন্ধানে চলে যায় পাখিরা। বিকেল ৪টা গড়ালেই ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরে আসে আবাসস্থলে। আর ভালো লাগার শুরুটা তখনই।

দল দলে এক রঙের পাখি আকাশে উড়ে বেড়ায়। অনেক দল অরুনিমার লেকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোতে বসে ডানা ঝাপটায়। সুরে সুরে অতিথি পাখিগুলো জানান দেয়, সাত সাগর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে অরুনিমায় এসে সুখেই আছে তারা।

পাখি দেখার পাশাপাশি অরুনিমার প্রায় ৫২ একরের বিশাল জায়গাজুড়ে গাছপালা, ফুল ও প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করেন পর্যটকরা। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে প্রায় দুই বছর পর পর্যটকরা ছুটে আসছেন পাখিদের এই মিলনমেলায়।

এ ছাড়া এই পর্যটনকেন্দ্রে যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক মানের গলফ মাঠ। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগমনে অনুন্নত অরুনিমাসংলগ্ন পানিপাড়ায় লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। পর্যটকদের বিনোদনের পাশাপাশি সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থান। সরকারের রাজস্বেও অর্থ জমা পড়ছে।

নড়াইল জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার দূরে কালিয়া উপজেলার নড়াগাতী থানার পানিপাড়া গ্রামে প্রায় ৫২ একর জমির ওপর গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের অন্যতম নেচারবেজ পার্ক অরুনিমা রিসোর্ট গলফ ক্লাব। এটি অরুনিমা ইকোপার্ক নামেও পরিচিত।

পার্কটি এখন পাখিদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে। গত সাত-আট বছর ধরে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে সাইবেরিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখানে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি আসে। এ সময় এদের সঙ্গে থাকে দেশি সাদা বক, কানি বক, শালিক, ফিঙ্গেসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।

সন্ধ্যায় পার্কের গাছগুলো মেতে ওঠে সাদা বক আর অতিথি পাখির ডাকাডাকির ছন্দে। মাতিয়ে তোলেন পার্কে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদেরও।

ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা সাংবাদিক মুজাহিদ শুভ বলেন, ‘অরুনিমা রিসোর্ট হচ্ছে একের ভেতর শত অনুষঙ্গের সমাহার। পাখি ও প্রকৃতির টানে অরুনিমায় এসেছি। দ্বিতীয়বার আসা হলো এখানে।’

নাইম আবির নামের এক দর্শনার্থী বলেন, ‘ভিডিও ও ফটোগ্রাফি আমার শখ। অরুনিমার যেখানে দাঁড়াই, সেখানেই ছবি তোলার ফ্রেম হয়ে যায়। এখানে এসে কাছ থেকে পাখি দেখা সত্যিই আনন্দের।’

একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের প্রডিউসার মুহতাসিম বিল্লাহ বলেন, ‘অনেক জায়গায় পাখি দেখার সুযোগ পেয়েছি। এ ক্ষেত্রে পর্যটকদের সঙ্গে অরুনিমার পাখিগুলোর সখ্য বেশি যেন। এখানে অনেক মানুষের আনাগোনাসহ কাছ থেকে ছবি তোলা হলেও পাখিগুলো ভয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করে না। দুইবার আসা হলো এখানে।’

খুলনা থেকে অরুনিমা রিসোর্টে ঘুরতে আসেন সরকারি বিএল কলেজের দর্শন শেষবর্ষের শিক্ষার্থী খাদিজা খাতুন তন্বী। তিনি বলেন, প্রকৃতির মাঝে আনন্দ উপভোগের অন্যতম স্থান হচ্ছে অরুনিমা। প্রকৃতির সব সৌন্দর্যই এখানে আছে।

কৃষি ও পরিবেশবান্ধব

বলা যেতে পারে অরুনিমা ইকোপার্ক একটি ফুল ও ফলের বাগানও। এখানে রয়েছে বৃহৎ একটি মাছের খামারও। বিনোদনপ্রিয় মানুষের জন্য এখানে রয়েছে পিকনিকের ব্যবস্থা। মনে হবে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আবহমান গ্রাম-বাংলার চিরচেনা রূপ আর আধুনিকতার সুপরিকল্পিত সমন্বয়ে সাজানো হয়েছে অরুনিমাকে।

যেন মনের মাধুরী মেশানো স্বপ্নপুরী। প্রবেশ পথেই দেখা যাবে প্রচুর ঝাউগাছ। দেখে মনে হবে এরা যেন সারিবদ্ধভাবে আগন্তুকদের অভ্যর্থনা জানাতে দাঁড়িয়ে আছে। হাজার হাজার ফুল ও ফলের চারাসহ বনজ ও ঔষধি বৃক্ষের চারা রোপণ করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ সমন্বয়।

এই পার্কে রয়েছে অন্তত দুই শ প্রজাতির গাছ। এসবের মধ্যে যেমন রয়েছে আম, কাঁঠাল, লিচু, নারকেল, চেরি, স্টার আপেল, জলপাই, পেঁপে, কুলসহ অসংখ্য ফলের গাছ, তেমনি রয়েছে ডেফোডিল, ক্যামেলিয়া, লিলি, কুমারী পান্থ, পদ্ম, নীলপদ্ম, রঙ্গন, কাঞ্চন, নানা প্রতাজির গোলাপ, মার্বেল টাস্ক, টগর ইত্যাদি। এসব গাছ পর্যটনকেন্দ্রের শোভাবর্ধনসহ প্রাকৃতিক রূপ এনে দিয়েছে।

অরুনিমার অভ্যন্তরে তিন একরের সবুজ মেহগনির বাগান যেন পরিণত হয়েছে সবুজ পাহাড়ে। এক একরের ঝাউবন, ৬৪৭টি আম্রপালি গাছের বাগান, ৫ কাঠার গোলাপ বাগান ও ১ হাজার ৪০০ প্রজাতির ফলদ, বনজ ও ঔষধি বৃক্ষ রয়েছে এখানে।

৬৬ বিঘা জমি নিয়ে রয়েছে ১৯টি বিশালাকৃতির পুকুর, যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে দারুণভাবে। এসব পুকুরে রুই, কাতলা, মৃগেল, পাঙ্গাস, চিংড়ি, বোয়াল, কইসহ অর্ধশতাধিক প্রজাতির মাছ চাষ করে আয়ও হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

কাছেই ঐতিহাসিক নিদর্শন

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এই কান্ট্রি সাইড ঘিরে রয়েছে নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন। এখান থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার পশ্চিমে কালিয়া উপজেলা শহরে রয়েছে বিশ্বখ্যাত সেতারবাদক রবি শংকর ও নৃত্যশিল্পী উদয় শংকর ভ্রাতৃদ্বয়ের জন্মস্থান, কিংবদন্তি চিত্রনায়িকা সুচিত্রা সেনের কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত দৌহিত্র ভবানী সেনের বসতবাড়ী এবং সেখানে রক্ষিত কয়েক শ বছরের পুরোনো ২০০ মণ ওজনের পিতলের রথ-মন্দির।

প্রায় দুই কিলোমিটার পূর্ব-পশ্চিমে নবগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত শুকতাইল গ্রামে হাজার বছরের স্থাপত্য নিদর্শন শুকতাইল মাঠ, যা প্রায় ১৭০০ বছর পূর্বে সম্রাট অশোকের শাসনামলে নির্মিত বলে লোকমুখে প্রচলিত আছে।

এ ছাড়া ৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে নড়াইল জেলা শহরের মাছিমদিয়া গ্রামে বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের বসতবাড়ি। সেখানে তিনি শিশুদের জন্য নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন শিশুস্বর্গ।

যেভাবে যাবেন এই পর্যটন কেন্দ্রে

রাজধানী ঢাকা থেকে অরুনিমায় আসার সহজ একটি পথ রয়েছে। বিশ্বরোডে মাওয়া-ভাঙ্গা-ভাটিয়াপাড়া হয়ে গোপালগঞ্জের চন্দ্রদীঘলিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে হাতের ডানে কিছুদূর গিয়ে বরফা ফেরিঘাট পার হলেই স্বপ্নপুরী ইকোপার্ক। আসতে সময় লাগবে সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা।

খুলনা ও যশোর থেকে নড়াইলের কালিয়া হয়ে এখানে যেতে সময় লাগে প্রায় তিন ঘণ্টা। এ ছাড়া নড়াইলের লোহাগড়া হয়ে মহাজন বাজার থেকে নবগঙ্গা ও মধুমতী নদী ফাইবার বোটে পাড়ি দিয়ে ইকোপার্কে যাওয়া যায়।

মহাজন থেকে নবগঙ্গা নদী পার হয়ে বড়দিয়া বাজার থেকে ভ্যান, মোটরসাইকেল বা নছিমনযোগেও ইকোপার্কে যাওয়া যায়।

আরেকটি পথ রয়েছে, সেটি হলো গোপালগঞ্জ শহরসংলগ্ন মানিকদাহ ফেরিঘাট পার হয়ে নড়াইলের কালিয়ায় অবস্থিত উপমহাদেশের বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী উদয় শংকর ও সেতারবাদক রবি শংকরের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি ঘুরেও সেখানে সহজে পৌঁছানো যায়। এখানে আগত বিনোদনপ্রিয় পর্যটকদের জন্য রয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

অরুনিমা রিসোর্ট গলফ ক্লাবের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইরফান আহমেদ বলেন, নিরাপদ অভয়াশ্রম হিসেবে এক যুগ ধরে দেশি-বিদেশি হরেক রকম পাখির বিচরণ এখানে। বিশেষ করে হরেক রকম অতিথি পাখির সঙ্গে বকসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশি পাখির মিতালি, যেন বন্ধুত্বপরায়ণ বাংলাদেশেরই প্রতিচ্ছবি। তাই অরুনিমাসহ আশপাশের মায়াবী পরিবেশ পাখির নিরাপদ আবাসস্থল। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে প্রায় দুই বছর পর পর্যটকরা আসছেন এখানে।

অরুনিমা রিসোর্ট গলফ ক্লাবের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের সদস্য খবির উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রায় আট মাস যাবৎ অতিথি পাখিসহ সারা বছর দেশি পাখির আনাগোনা থাকে এখানে। পাখিদের নিরাপদ অভয়াশ্রমখ্যাত অরুনিমার সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে গ্রামবাসীসহ রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

তিনি জানান, পাখি দেখার সুবিধার্থে সুবিশাল লেকের মাঝে এবার বোট আইল্যান্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া লেকের পাশে দাঁড়িয়ে এবং বোটে করে কাছ থেকেই পাখি দেখার সুযোগ রয়েছে অরুনিমায়ই।

এ বিভাগের আরো খবর