গাইবান্ধা সদর ও পাবনার বেড়া উপজেলায় দায়িত্ব পালনের সময় অনিয়ম ও দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ ছিল প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে। অভিযোগ মাথায় নিয়েই তাকে বদলি করা হয় রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলায়। এখানেও উঠেছে একই ধরনের অভিযোগ।
পাবনায় ঘুষসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠার পর সালামের বিরুদ্ধে তদন্তের উদ্যোগ নেয়া হয়। তিনি বদলি হয়ে যাওয়ার পর থেমে যায় সে উদ্যোগ।
গাইবান্ধায় একাধিক শিক্ষক লিখিত অভিযোগ দেয়ার পর সেখান থেকে বদলি করা হয় তাকে। সেখানকার প্রশাসনও এ বিষয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
বরকলের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অভিযোগ, গ্রেড উন্নীত করতে উপজেলার প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষককে তাদের বেতনের ১০ শতাংশ করে চাঁদা দিতে হয়েছে। চাঁদা নেয়ার সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির কয়েকজন নেতাও জড়িত।
সালামের বিরুদ্ধে বরকলে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ নিয়ে জানলেও গাইবান্ধা ও পাবনায় অতীত রেকর্ডের বিষয়ে কিছু জানা নেই বলে জানিয়েছেন রাঙ্গামাটির জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন।
রাঙামাটির বরকলের শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে সালাম দায়িত্ব নেন ২০২১ সালে।
সে বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা ১৪তম গ্রেডের পরিবর্তে ১৩তম গ্রেডের বেতন-বোনাসসহ সব সুযোগ-সুবিধা পাবেন বলে ঘোষণা দেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
বরকলের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অভিযোগ, গ্রেড উন্নীত করতে উপজেলার প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষককে তাদের বেতনের ১০ শতাংশ করে চাঁদা দিতে হয়েছে। চাঁদা নেয়ার সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির কয়েকজন নেতাও জড়িত।
মাইছছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মেলিনা চাকমা নিউজবাংলাকে জানান, শুধু গ্রেডে উন্নীত করা নয়, অফিশিয়াল যে কোনো কাজেই তাদের টাকা দিতে হয়।
তবে শিক্ষা কর্মকর্তা সালাম উল্টো দোষ চাপিয়েছেন সহকারী শিক্ষক সমিতির নেতাদের ওপর। তিনি বলেন, ‘শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার সঙ্গে সমিতির নেতারা জড়িত। বিলের কাজের জন্য মাসে দুই-তিনবার তাদের ঢাকায় যেতে হয়। সে কারণে টাকা নিয়েছেন। তবে অফিশিয়ালি টাকা নেয়ার কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি।
মেলিনা বলেন, ‘১৩তম গ্রেডের বকেয়া বিলের কাজ করতে শিক্ষক সমিতির একজনকে ৬০০ টাকা দিয়েছি।’
এই স্কুলের আরেক শিক্ষক জলসা চাকমা জানান, টাকা না দিলে তার কাগজপত্র খালি যাবে এবং বেতনের কোনো কাজ হবে না বলে হুমকি দেন বরুনাছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও শিক্ষক সমিতির সদস্য পূণ্যবান চাকমা।
এ বিষয়ে পূণ্যবান বলেন, ‘বকেয়া বিলের কাজ করতে সহকারী শিক্ষকদের ন্যূনতম একটা ফি দিতে বলা হয়েছিল। পরে শিক্ষকরা অভিযোগ করায় টাকা দিতে হবে না বলে জানানো হয়েছে।’
টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে কি না সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে অভিযোগকারী শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলব।’
তবে শিক্ষা কর্মকর্তা সালাম উল্টো দোষ চাপিয়েছেন সহকারী শিক্ষক সমিতির নেতাদের ওপর।
তিনি বলেন, ‘শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার সঙ্গে সমিতির নেতারা জড়িত। বিলের কাজের জন্য মাসে দুই-তিনবার তাদের ঢাকায় যেতে হয়। সে কারণে টাকা নিয়েছেন। তবে অফিশিয়ালি টাকা নেয়ার কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি।
‘এর আগেও কয়েকজন সমিতির নেতাদের বিরুদ্ধে টাকা নেয়ার অভিযোগ করেছিলেন। তখন তাদের বলেছিলাম লিখিতভাবে অভিযোগ দেয়ার জন্য।’
বরকল দোছরীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও শিক্ষক সমিতির সভাপতি রিমেশ চাকমার দাবি, ‘বকেয়া বিলের বিষয়ে আব্দুস সালামের সঙ্গে কথা বললে তিনি প্রতিটি শিক্ষকের কাছ থেকে বেতনের ১০ শতাংশ করে টাকা লাগতে পারে বলেন। তবে আমরা বিষয়টার বিরোধিতা করেছিলাম। পরে ন্যূনতম একটা খরচ শিক্ষকদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে।
‘ব্যক্তিগতভাবে আমিও জানি যে, এসব বিষয়ে কাজ করতে গেলে কিছু টাকা লাগেই। তবে শিক্ষা কর্মকর্তা যে এখন একতরফাভাবে আমাদের ওপর দায় চাপাচ্ছেন সেটি সঠিক নয়।’
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিরণ কুমার অধিকারী টাকা নেয়ার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টাকা নেয়ার বিষয়ে কথা উঠেছিল কিন্তু পরে নেয়া হয়নি।’
তবে এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের কোন জায়গায় টাকা নিচ্ছে না বলেন তো? দেশে এত অনিয়ম হচ্ছে সেগুলা দেখতে পাচ্ছেন না। আপনি আমাদের নিয়ে পড়ে আছেন কেন?’
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে রাঙ্গামাটি জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘বরকল উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দপ্তরি নিয়োগে টাকা নেয়া, ঠিকভাবে কাজ না করা ও অফিসের অনিয়মের অভিযোগে তদন্ত চলছে। শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তে এসেছিলেন। তিনি জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবেন।
‘যদি অভিযোগের সত্যতা মেলে তাহলে জেলা প্রশাসক সিদ্ধান্ত নেবেন বিভাগীয় মামলা হবে কি না। শিক্ষকদের বকেয়া বেতনের জন্য টাকা নেয়ার বিষয়ে এখনও কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। তবে মৌখিকভাবে শুনেছি। বিষয়টি আমাদের নলেজে আছে।’
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিরণ কুমার টাকা নেয়ার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টাকা নেয়ার বিষয়ে কথা উঠেছিল কিন্তু পরে নেয়া হয়নি।’ তবে এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের কোন জায়গায় টাকা নিচ্ছে না বলেন তো? দেশে এত অনিয়ম হচ্ছে সেগুলা দেখতে পাচ্ছেন না। আপনি আমাদের নিয়ে পড়ে আছেন কেন?
রাঙ্গামাটি আসার আগে সালাম ছিলেন পাবনার বেড়ার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। বেড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সবুর আলী জানান, সেখানকার স্কুলগুলোর প্রধান শিক্ষকরা সালামের বিরুদ্ধে ঘুষ দাবি করার অভিযোগ করেছেন। তবে সে সময় তার বদলির সময় হয়ে যাওয়ায় এর তদন্ত এগোয়নি।
গাইবান্ধা সদরের প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা থাকার সময়ও সালাম বেশ কিছু অভিযোগ ছিল বলে জানান জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি জহুরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘কিছু টিচারের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। কিছু অনিয়ম-দুনীতিও ছিল তার বিরুদ্ধে। একাধিক শিক্ষকের সঙ্গে অসদাচরণও করেছিলেন তিনি।
‘তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ মন্ত্রণালয়সহ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্তে সত্যতাও পায়। পরে তাকে এখান থেকে রংপুর বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে সংযুক্ত করা হয়। বিশেষ করে তিনি শিক্ষক বদলি বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া কয়েকটি দপ্তরে তার বিরুদ্ধে একাধিক শিক্ষক অনিয়মের লিখিত অভিযোগও করেন।’
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন পাবনার ইমরোজ খন্দকার বাপ্পি ও গাইবান্ধার পিয়ারুল ইসলাম।