করোনাভাইরাসের অতিবিস্তারের মধ্যে ভোট স্থগিতের নির্দেশ একাধিকবার এসেছে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে। তবে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে যখন শাটডাউনকালের মতো সংক্রমণ ঘটছে, সংক্রমণের হার প্রায় প্রতিদিনই যখন আগের দিনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, সে সময় ভোট স্থগিত করতে নারাজ নির্বাচন কমিশন।
অথচ এই সময়ে দেশে সামাজিক-রাজনৈতিক যে কোনো জমায়েত নিষিদ্ধ। এমনকি রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় সর্বোচ্চ ১০০ জনের উপস্থিতির সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে, তাও তাদের থাকতে হবে টিকার অথবা করোনা নেগেটিভের সনদ।
এই বিধিনিষেধের মধ্যেও নির্বাচন কমিশন নারায়ণগঞ্জে জমজমাট ভোট শেষ করেছে, এখন আগামী ৩১ জানুয়ারি ষষ্ঠ ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রচার চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে।
নির্বাচন কমিশন ভোটের প্রচারকে বিপজ্জনক না ভাবলেও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড শিক্ষাঙ্গনে পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচন চালিয়ে যাওয়াকে সমীচীন মনে করছে না। আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সশরীরে ক্লাস বন্ধ থাকাকালে কোনো ভোট হবে না বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। যদি শিক্ষাঙ্গনে ক্লাস বন্ধের সময়সীমা আরও বাড়ে, তাহলে নির্বাচনে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমাও বাড়বে।
একজন নির্বাচন কমিশনার দাবি করেছেন, গ্রাম এলাকায় ভোটে সেভাবে জমায়েত হয় না, প্রার্থীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচার চালান। তাই সেখানে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কম। তবে একজন ভাইরাস বিশেষজ্ঞ এই যুক্তিকে বিপজ্জনক বলে উল্লেখ করে বলেছেন, বিধিনিষেধের মধ্যে ভোট সংক্রমণ বাড়াবে আরও বেশি।
২০২১ সালের ১১ এপ্রিল থেকে ধাপে ধাপে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তারিখ দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। তবে ১ এপ্রিল সব নির্বাচন স্থগিত করে দেয়া হয়। এরপর ১০ জুন আবার ভোট স্থগিতের আদেশ দেয়া হয়।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পাশাপাশি বেশ কিছু পৌরসভা এবং লক্ষ্মীপুর-২, ঢাকা-১৪, কুমিল্লা-৫ ও সিলেট-৩ সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনও পিছিয়েছে করোনার জন্য।
এবার কেন তবে ভোট চালিয়ে যেতে চাইছে নির্বাচন কমিশন, সে প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে মিলেছে এমন এক তথ্য, যা নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে চান না নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি। তার আগেই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন শেষ করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল কমিশন। এই অবস্থায় এই ভোট পিছিয়ে গেলে তা নতুন কমিশনকে তদারকি করতে হবে। এ কারণে বর্তমান কমিশন ভোট চালিয়ে নিতে মরিয়া বলে অভিযোগ আছে।
দেশে ইউনিয়ন পরিষদের সংখ্যা ৪ হাজার ৫৭৪টি। সব মিলিয়ে ৮ ধাপে ৪ হাজার ১৩৮টি ইউনিয়নে ভোটের ব্যবস্থা করেছে ইসি। এরই মধ্যে ৩ হাজার ৭৭৩টি ইউনিয়নে ভোট শেষ হয়েছে।
ষষ্ঠ ধাপে ৩১ জানুয়ারি ২১৯ ইউপিতে, সপ্তম ধাপে ৭ ফেব্রুয়ারি ১৩৮ ইউপিতে এবং অষ্টম ধাপে ১০ ফেব্রুয়ারি ৮ ইউপিতে ভোট হবে।
নির্বাচন কমিশনের যে যুক্তি
নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের যে শিডিউল দেয়া আছে, সে হিসাবে যথাসময়ে নির্বাচন পরিচালনা করা হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত শিডিউল পরিবর্তন না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আগের শিডিউল মতেই নরমালি কাজ হবে।’
জমায়েত নিষিদ্ধ থাকা অবস্থায় এলাকায় সভা-সমাবেশ ও মিছিলে জমায়েতকে নির্বাচন কমিশন কেন সমস্যা মনে করছে না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ইউপি নির্বাচনগুলো একেবারে প্রান্তিক পর্যায় বা একেবারে গ্রাম এলাকায় হচ্ছে। এসব গ্রামে নির্বাচন ঘিরে তেমন জনসভাও হয় না, জনসমাগমও হয় না। প্রার্থীরা নিজেরা কয়েকজন মিলেই বাড়ি গিয়ে গিয়ে প্রচারণা চালান। তারপরও যাতে সেখানে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা হয় তা ওপর গুরুত্ব দেয়া হবে।’
নির্বাচন কমিশনের ভোট স্থগিত করার আগের আদেশের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া হলে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘তবে যদি করোনা পরিস্থিতি খুব বেশি অবনতি হয়, তাহলে অবশ্যই কমিশন তা দেখবে। সে অনুযায়ী প্রোগ্রামে পরিবর্তনও আসতে পারে। তার আগ পর্যন্ত যেভাবে আছে সেভাবেই চলবে।’
করোনার বিধিনিষেধের মধ্যে বাণিজ্য মেলার মতো আয়োজন চালু রাখা নিয়ে যে সমালোচনা আছে, সেই প্রসঙ্গও টানলেন এই নির্বাচন কমিশনার। তিনি বলেন, ‘জনসভা বা পথসভার দরকার নাই, এমনিতেই যেখানে-সেখানে হাজার হাজার মানুষের সমাগম। বাণিজ্য মেলায় তো নির্বাচন নেই। সেখানে কেন এত মানুষ?’
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ গত ৪ অক্টোবর নিয়ন্ত্রণে আসার পর চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণেই ছিল। তবে ৭ জানুয়ারি প্রথমবারের মতো পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার পর তৃতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা জাগে, যা গত ২১ জানুয়ারি নিশ্চিত হয়ে যায়।
এখন পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে, যে হারে শনাক্ত দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় শাটডাউন চলাকালে দেখা গেছে। দিনে শনাক্ত এখন ১১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, যদিও মৃত্যুর সংখ্যা এবার তুলনামূলক কম।
এই যুক্তি প্রত্যাখ্যান স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের
করোনার এমন অতিবিস্তারের মধ্যেও ভোট চালিয়ে যেতে নির্বাচন কমিশন যে যুক্তি দেখিয়েছে, তা মানছেন না দেশসেরা ভাইরাস বিশেষজ্ঞদের একজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার বিধিনিষেধের সঙ্গে চলমান বিভিন্ন কার্যক্রম কন্টাডিকটোরি (সাংঘর্ষিক)। একদিকে করোনার সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী, অন্যদিকে মেলা চলছে, নির্বাচন চলছে, শপিং মল চলছে। সেসব জায়গায় স্বাস্থ্যবিধিও মানা হচ্ছে না। করোনার সময় যেভাবে সবকিছু পরিচালনার উচিত ছিল সেভাবে করা হচ্ছে না। এর খেসারত দিতে হবে। সংক্রমণের হার ৩১ শতাংশে পৌঁছে গেছে। তাই এখনই এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’
নজরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আর নির্বাচন করোনা সংক্রমণে কতটা প্রভাব ফেলে তা তো নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেই দেখা গেছে। টেলিভিশন আর সংবাদমাধ্যমে যা দেখলাম, তাতে তো কেউ তেমন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে না। তাই নির্বাচন যেখানেই হোক তা করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দেবে। ক্ষেত্র নির্বাচন কিছুটা পিছিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে।’