বহুল প্রতীক্ষিত প্রকল্প এলাকা মহেশখালী-মাতারবাড়ী ইন্টিগ্রেটেড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (মিডি) ঘিরে এখন বিশদ মহাপরিকল্পনা (কম্প্রিহেনসিভ মাস্টার প্ল্যান) নিয়েছে সরকার।
এর আওতায় শিগগির একটি স্বতন্ত্র আইন তৈরি হচ্ছে। যে আইনের ক্ষমতাবলে ‘মিডি’ এলাকা পরিচালনায় একটি শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে।
এ কর্তৃপক্ষ হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রয়োজন অনুযায়ী তা নিজ ক্ষমতাবলে পরিকল্পিত ‘মিডি’ গড়তে নতুন প্রকল্প গ্রহণ, অনুমোদন, অর্থায়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারবে। সেই সঙ্গে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এলাকায় টাউনশিপ গড়ে তোলা, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিবেশ সুরক্ষাসহ চিহ্নিত এলাকার আইন-শৃঙ্খলা সব কিছুই পরিচালনা করতে পারবে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৈরি করা এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
বর্তমানে দেশে বহুমুখী অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিরাট কর্মযজ্ঞ চলছে এই ‘মহেশখালী-মাতারবাড়ী ইন্টিগ্রেটেড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ’ এলাকায়।
বিদ্যুৎকেন্দ্র, সমুদ্রবন্দর, এলএনজি, এলপিজি টার্মিনাল, ইকোনমিক জোন, ওয়াটার ফ্রন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ, টাউনশিপ ডেভেলপমেন্ট, পানিসম্পদ উন্নয়ন এবং পরিবেশের সুরক্ষাসহ ইকোট্যুরিজম পার্কসহ ৩৭টি মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে সমানতালে। এ ছাড়া এসব মেগা প্রকল্পসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সেক্টর উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুযায়ী বর্তমানে এখানে ৬৮টি প্রকল্প চিহ্নিত করা গেছে।
ইতিমধ্যে চিহ্নিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ছয়টি প্রকল্প শেষ হয়েছে। প্রায় ৭৮ হাজার ৫৪৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকার ছয়টি প্রকল্পের কাজ চলমান। অন্যান্য প্রকল্প সম্ভাব্যতা যাচাইসহ বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি প্রকল্প জাপান সরকারের বিনিয়োগে বাস্তবায়নের প্রস্তাব রয়েছে।
সরকার আশা করছে, বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগে এসব অবকাঠামো উন্নয়ন দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ, কানেক্টিভিটি এবং আন্ত ও আন্তর্জাতিক শিল্প-বাণিজ্য প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তবে দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, মিডি এলাকাজুড়ে চলতে থাকা এসব উন্নয়ন কাজের প্রায় সবটাই হচ্ছে বিচ্ছিন্নভাবে। যেমন- মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের দায়িত্বে আছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের দায়িত্বে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়। সেখানে যে অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে, সেটির দায়িত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ। গ্যাসলাইন, এলএনজি, রাস্তাঘাট হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন দপ্তর আলাদা করে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যার ফলে কাজের সমন্বয় হচ্ছে না। কাজে ব্যাঘাত ঘটছে।
একইভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন-সহযোগী জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) বহুল আলোচিত এই প্রকল্পে ২০ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব রয়েছে, যেখানে জাইকার ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্সের (ওডিএ) বিনিয়োগের পরিমাণ থাকছে ১০ বিলিয়ন ডলার। বাকি ১০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করবে জাপানের বেসরকারি খাত।
বর্তমানে ৩০০-এর বেশি জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে। তবে এ প্রকল্পে জাপানের বেসরকারি খাতের এই বিনিয়োগ কোথায় হবে, পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চলে, না দেশি-বিদেশিদের সমন্বিত কোনো অঞ্চলে, সে বিষয়টি এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও ঢাকায় জাপানি দূতাবাসের তথ্য মতে, এখনও জাপান প্রস্তাব ও সমীক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, মিডি উদ্যোগে জাপানের ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ বাস্তবায়ন পর্যায়ে গড়ালে সেটি দেশের অর্থনীতির জন্য হবে বিরাট মাইলফলক। তবে প্রশ্ন হলো, জাপানি উদ্যোক্তারা যখন বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আসবেন, বিনিয়োগসংক্রান্ত তথ্য ও সেবার জন্য কার কাছে যোগাযোগ করবেন? তাদের অনুকূলে প্রয়োজনীয় ভূমি কে বরাদ্দ দেবে এবং তাদের সুষ্ঠু পরিচালন তদারকিই বা কে করবে? সে রকম কোনো সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ মিডিতে নেই।
এ বিষয়ে উত্তর খোঁজার চেষ্টায় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, শিগগিরই এই ‘মিডি’ পরিচালনায় কর্তৃপক্ষ তৈরি করা হবে। এ জন্য আগামী দুই মাসের মধ্যে মহেশখালী-মাতারবাড়ী ইন্টিগ্রেটেড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (মিডি) কর্তৃপক্ষ গঠনে আইনের খসড়া তৈরি করতে বলেছে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়।
এ লক্ষ্যে লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে বেজা, বিডা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, অর্থ বিভাগ, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, রেলপথ মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয় প্রতিনিধি এবং কক্সবাজার জেলা প্রশাসককে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে।
এই কমিটি তাদের কাজের সুবিধার জন্য দরকারি সদস্য সংযুক্ত করতে পারবে। কমিটি সর্বোচ্চ দুই মাসের মধ্যে একটি খসড়া আইন তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠাবে।
জানা গেছে, বর্তমানে মিডি পরিচালিত হচ্ছে মিডি সমন্বয় কমিটি দিয়ে। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী এ কমিটি অনুমোদন করেন। এরপর থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি সেলের তত্ত্বাবধানে অনুমোদিত কমিটি মিডির কার্যক্রম সমন্বয় ও মনিটরিং করে আসছে।
পরে মিডি কর্তৃপক্ষ গঠনের উদ্দেশ্যে ২০১৯ সালের ৫ মার্চ একটি আইনের খসড়া তৈরি করা হয়। এটির বিষয়ে মতামত পেতে প্রকল্পের বড় স্টেকহোল্ডার জাইকাকেও পাঠানো হয়। তবে এখনও জাইকা থেকে মতামত পাওয়া যায়নি। এ কারণে এ বিষয়ে আর কোনো অগ্রগতিও হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায, আইনের খসড়াটি জাইকার মনঃপূত হয়নি। তা ছাড়া তারা মিডি প্রকল্পে বিনিয়োগের প্রস্তাব দিলেও এখনও তারা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শেষ করতে পারেনি। যে কারণে মতামত দেয়ারও প্রয়োজন মনে করেনি।
এমন প্রেক্ষাপটে মিডি কর্তৃপক্ষ গঠন বিষয়ে চলতি মাসের ১৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি বিষয়ক) জুয়েনা আজিজের সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের উপস্থিতিতে ভার্চুয়ালি একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এতে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণসহ বহুমুখী উন্নয়ন কার্যক্রমের পরিচালন ও নিয়ন্ত্রণের সুবিধায় একটি আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের আইনি প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার ওপর জোর দেয়া হয়।
এ বৈঠকে মিডি কর্তৃপক্ষ গঠনে আগের খসড়াটি সংশোধনের পরামর্শ আসে। মুখ্য সচিব কায়কাউস জানান, মিডির প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়নসহ পরবর্তীতে সেগুলো পরিচালনার জন্য একটি স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তিনি উপযুক্ত একটি কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়ে জাপান, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সফল মডেলগুলো পর্যালোচনার পরামর্শ দেন।
কায়কাউস বলেন, মিডি এলাকার জন্য জাইকা শুধু ভূমি ব্যবহার জরিপ পরিকল্পনা করেছে, কিন্তু চাহিদা মূল্যায়ন হয়নি। সে জন্য কম্প্রিহেনসিভ স্ট্যাডি এবং মাস্টার প্ল্যানের প্রয়োজন রয়েছে। এ জন্য এমন একটি আইন তৈরি করতে হবে, যেখানে কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রস্তাব থাকে এবং গঠিত কর্তৃপক্ষ যাতে একুশ শতকের উপযোগী রূপান্তরমুখী একটি আধুনিক শহর নির্মাণ করতে সক্ষম হয়।
আইনটির প্রয়োজনীয় সংশোধনের জন্য লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানান কায়কাউস।
এ প্রসঙ্গে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব জানান, গতানুগতিক ধারণার বাইরে ব্যতিক্রমধর্মী সিটি গভর্নমেন্টের আদলে একটি শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ গঠনই প্রকল্পের সুন্দর ভবিষ্যৎ দেখাতে পারে। সে জন্য একটি আইনের প্রয়োজন হবে। যে আইন মিডির মাস্টারপ্ল্যানের কাজও করবে।