বরিশালের বিশাল একটি আয়তনজুড়ে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে আওয়ামী লীগ ও পরিবহন শ্রমিক নেতা কামাল হোসেন মোল্লা লিটন ও তার বড় ভাই আজাদ হোসেন মোল্লা কালামের বিরুদ্ধে। থ্রি হুইলার যানসহ যাত্রীবাহী বাস কাউন্টার থেকে চাঁদাবাজি, এমনকি ধর্ষণ ও এতে সহায়তার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে।
এ দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে এলাকাবাসী ও পরিবহন শ্রমিকদের নানা অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রকাশ্যে কেউ কোনো কথা বলার সাহস পান না। দুই ভাই জনপ্রতিনিধি হওয়ায় তাদের পৃথক বাহিনীও আছে।
এর আগেও কালাম মোল্লা সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন ও ট্রাক থেকে চাঁদাবাজি করা নিয়ে আলোচনায় ছিলেন। অন্যদিকে ধর্ষণের ঘটনায় কালাম মোল্লা গ্রেপ্তার হওয়ার পর সাংবাদিকদের ফোন করে গালাগাল ও হামলা-মামলার হুমকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তার ছোট ভাই লিটন মোল্লার বিরুদ্ধে। বরিশালের বিভিন্ন থানায় এ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা রয়েছে। পাশাপাশি আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকরা ছবি তোলায় তাদের জেল থেকে বের হয়ে দেখে নেয়ার হুমকি দেন কালাম মোল্লা।
গত ১৩ জানুয়ারি রাতে কাশিপুরের মগরপাড়া এলাকায় এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে ১৪ জানুয়ারি বিকেলে পুলিশ কালাম মোল্লাকে গ্রেপ্তার করে।
কালাম মোল্লাকে ১৫ জানুয়ারি আদালতে তোলা হলে বরিশাল মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক পলি আফরোজ তাকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা পেয়েছে এবং অভিযোগকারীকে মারধরের বিষয়টিও নিশ্চিত হয়েছে বলে আদালতকে জানায়। আসামি প্রভাবশালী হওয়ায় পুলিশ আদালতে আসামিকে জামিন না দিতে আবেদন জানায়।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, বরিশাল নগরীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল নথুল্লাবাদ থেকে রহমতপুর পর্যন্ত বিশাল এলাকাজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করেছেন কালাম মোল্লা ও লিটন মোল্লা। কালাম মোল্লা ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও তার ভাই লিটন মোল্লা কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। এই দুই ভাই আবার বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর একনিষ্ঠ অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
লিটন মোল্লার বিরুদ্ধে বরিশাল শহরে থ্রি হুইলার থেকে ‘বরিশাল জেলা থ্রি হুইলার মোটরযান শ্রমিক ইউনিয়নের’ ব্যানারে চাঁদা তোলার অভিযোগ রয়েছে। তিনি ওই সংগঠনের সভাপতি। পাশাপাশি নথুল্লাবাদের বিএমএফ কাউন্টারের সামনে বাস থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
চাঁদাবাজির অভিযোগে ২০২০ সালের আগস্ট মাসে তার শ্যালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ওই ঘটনায় করা মামলার প্রধান আসামি ছিলেন লিটন মোল্লা। এর আগে চাঁদার দাবিতে বরিশাল কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে গোল্ডেন লাইন পরিবহনের কাউন্টার ম্যানেজারকে কুপিয়ে জখম করার অভিযোগ ওঠে লিটন মোল্লার বিরুদ্ধে। এরপর থেকে তিনি দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থেকে আদালতে আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাকে জেল হাজতে পাঠায়। জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে তিনি তার পুরোনো কর্মকাণ্ড আবার শুরু করেন।
জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের কমিটি থাকলেও এর অঘোষিত নিয়ন্ত্রক লিটন মোল্লা। তার বিরুদ্ধে প্রতিটি পরিবহন কাউন্টার থেকে প্রতি মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা চাঁদা তোলার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সংবাদ সম্মেলন করে এ অভিযোগ তুলেছিলেন কাউন্টার ম্যানেজাররা। করোনার লকডাউনের সময় গভীর রাতে অবৈধভাবে মাইক্রোবাসে যাত্রী পরিবহন করার অভিযোগ ছিল লিটনের বিরুদ্ধে, যা তৎকালীন উপপুলিশ কমিশনার (উত্তর) খায়রুল আলমের হস্তক্ষেপে বন্ধ হয়ে যায়। এই সব ঘটনায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাকে ১০ নভেম্বর বহিষ্কারও করেছিল।
এদিকে লিটনের বড় ভাই কাউন্সিলর কালাম মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নগরীর প্রবেশদ্বার গড়িয়ারপারে দিনভর ট্রাক থেকে চাঁদা তোলেন। তিনি বরিশাল জেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি। শুধু তা-ই নয়, সিটি করপোরেশনের জমিতে দোকান নির্মাণকে কেন্দ্র করে কয়েক বছর আগে মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহর সঙ্গেও দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন কালাম। সংবাদ সম্মেলন করে মেয়রের বিরুদ্ধে বিবৃতিও দিয়েছিলেন তিনি।
এই দুই ভাই মেয়রের নাম ভাঙ্গাইয়া যত ধরনের অপকর্ম আছে, সব করে। রাস্তাঘাটে ওনাগো লোকজনে মানুষগো কম হেনস্তা করে না। জেল খাইটাও শিক্ষা হয় না।
দুই ভাই মিলে কাশিপুর এলাকাজুড়ে মাদকদ্রব্য কেনাবেচার বিশাল সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন বলে গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন এই প্রতিবেদকের কাছে।
কাশিপুরের গণপাড়া এলাকার হাফিজ মল্লিক নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘কালাম মোল্লা ও লিটন মোল্লার অত্যাচারে আমরা অতিষ্ঠ। সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে এরা বিশাল এলাকাজুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করে। কোনো জায়গায় জমি নিয়ে ঝামেলা থাকলে সেখানে একটি পক্ষে অবস্থান নিয়ে জমি দখল করে দেন তারা। নারী কেলেঙ্কারি তাদের নতুন কেচ্ছা নয়। এর আগেও এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে, তবে ভয়ে এগুলো প্রকাশ্যে আসেনি।
‘এ ছাড়া লিটন নিজেই সারা দিন মাদক সেবনের মধ্যে থাকেন। মাদকসেবী ব্যক্তি যা করতে পারার কথা, ঠিক তা-ই করেন তিনি। কালাম নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দেন সব জায়গায়। নামসর্বস্ব পত্রিকার কার্ড বানিয়ে দিয়েছেন তার লোকজনকে। তাদের সঙ্গে নিয়েই সব অপকর্ম করেন তিনি।’
মগরপাড়া এলাকার বাসিন্দা দিনমজুর মোহাম্মদ জিয়াউর বলেন, ‘এই দুই ভাই মেয়রের নাম ভাঙ্গাইয়া যত ধরনের অপকর্ম আছে, সব করে। রাস্তাঘাটে ওনাগো লোকজনে মানুষগো কম হেনস্তা করে না। জেল খাইটাও শিক্ষা হয় না। কোনো লজ্জা শরমও নাই। জেল দিয়া বাইরাইলে মনে হয়, এরা আরও বেশি ক্ষমতা পায়।’
এমন একটা অবস্থা, টার্মিনালে লিটনের ভয়ে তটস্থ সবাই। কেননা সবাই তো জানে মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ তাকে সাপোর্ট দেয়।
বরিশাল কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের দুই পরিবহন শ্রমিক নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজির নেপথ্যে লিটন ও কালাম মোল্লা। একজন বাস, থ্রি হুইলার ও মাইক্রোবাস থেকে এবং অন্যজন ট্রাক থেকে চাঁতা তোলেন। বরিশাল জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন ও জেলা বাস মালিক গ্রুপের সদস্য লিটন মোল্লা। বাস মালিক গ্রুপের সদস্য হয়েছেন বছর কয়েক আগে। বাস টার্মিনাল নিয়ন্ত্রণে নিতে বাস মালিক গ্রুপের সদস্য হওয়াটা জরুরি ছিল তার।
‘এমন একটা অবস্থা, টার্মিনালে লিটনের ভয়ে তটস্থ সবাই। কেননা সবাই তো জানে, মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ তাকে সাপোর্ট দেন। কিন্তু আসলে দেন, নাকি শুধু মেয়রের নাম বিক্রি করে এমনটা সে করছে, তা আল্লাহ জানে। প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা পরিবহন সেক্টর থেকে চাঁদাবাজি করে থাকে লিটন ও কালাম।’
এদিকে কালাম মোল্লা গ্রেপ্তারের সংবাদ প্রকাশ করায় কয়েকজন সাংবাদিককে ফোন করে হুমকি দেওয়া হয়েছে।
বরিশালের স্থানীয় দৈনিক দেশ জনপদ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ও ঢাকা টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমের বরিশাল প্রতিনিধি এস এন পলাশ বলেন, ‘শনিবার সন্ধ্যার পর একটি অপরিচিত নম্বর থেকে কল করে লিটন মোল্লা আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন কালাম মোল্লাকে গ্রেপ্তারের সংবাদ করার কারণে। আমার বিরুদ্ধে মামলা করে জেল খাটানোর হুমকি দেয়া হয় এবং আমি যাতে সাংবাদিকতা করতে না পারি, সেই জন্য ১০ লাখ টাকা বাজেট রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি। এই ঘটনায় আমি কোতোয়ালি মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছি।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল হোসেন মোল্লা লিটন ওরফে লিটন মোল্লাকে টানা দুই দিন তার ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। খুদেবার্তা দিয়েও মেলেনি উত্তর। তবে তার ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, পলাতক রয়েছেন লিটন মোল্লা।
এসব বিষয়ে বরিশাল জেলা সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরিশাল জেলা কমিটির সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, ‘দুই ব্যক্তি একের পর এক অপরাধ করছেন, আর সেটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় সেই অপরাধ বেড়েই চলছে। এদের লাগাম টানা দরকার। এরাই সমাজের বিষফোঁড়া। দিনভর মাদকের নেশায় বুদ হয়ে থেকেই এমন অপকর্ম করছেন তারা।
‘পরিবহন সেক্টরে সুষ্ঠু পরিবেশ দরকার। পুলিশ ইচ্ছা করলে কি না পারে। জনগণের শান্তির জন্য এমন অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, যাতে তারা রাজনৈতিক প্রশয়ে এমন কর্মকাণ্ড আর না করতে পারে। যারা ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ করতে পারেন, তাদের দিয়ে সমাজ নষ্ট ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব নয়।’
উদীচী বরিশালের সভাপতি সাইফুর রহমান মিরণ বলেন, ‘একে তো কাউন্সিলর ধর্ষণে অভিযুক্ত হয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন, তার ওপর সেই সংবাদ প্রকাশ করায় সাংবাদিকদের আদালতে চত্বরে হুমকি দিচ্ছেন। এটা অসুস্থ মানসিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এরা বরিশালের চিহ্নিত সন্ত্রাসী। এমন কোনো দিন নেই যে তাদের অপকর্ম নেই। এদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে মনে হয় না কোনো বিশেষ মহল ছাড়া কেউ ক্ষুব্ধ হবে। সাধারণ জনগণ ও পরিবহন শ্রমিকরা নির্যাতন থেকে বাঁচবে।’
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এনামুল হক বলেন, ‘জনগণের নিরাপত্তায় যারা বাধা হচ্ছেন বা বিঘ্ন ঘটাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। কারও রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে আমরা ছাড় দিচ্ছি না। অপরাধ করলে সাজা ভোগ করতেই হবে। আপনারা ইতিমধ্যে দেখছেন, কীভাবে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করছি অপরাধের বিরুদ্ধে। জনগণকে যারা রক্তচক্ষু দেখাবে বা নির্যাতন করবে, পুলিশও তাদের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে দাঁড়িয়েছে। আর সাংবাদিকদের হুমকির বিষয়টিও আমাদের নজরে এসেছে। দ্রুতই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’