সাপকে ভয় পান না, এমন মানুষ হাতে গোনা খুব বেশি নেই। সাপকে ‘পোষ মানানোর’ অনেক বিদ্যা নিয়ে আছে কৌতূহল। এ-সংক্রান্ত প্রচলিত অনেক গল্প-কল্পনায় আকৃষ্ট হয় মানুষ।
উপমহাদেশের বিভিন্ন উপকথা, পুরাণ, গ্রামীণ কাহিনিতে সাপকে বর্ণনা করা হয় ভয়ংকর ক্ষতিকর ও বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী প্রাণী হিসেবে।
মহামূল্যবান মণি সৃষ্টি করা থেকে শুরু করে উড়তে পারা ও মানুষকে সম্মোহিত করার অলৌকিক ক্ষমতার গল্প সাপকে ঘিরে প্রচলিত। এসবের কতটা সত্যি বা কতটা মিথ্যা, তা যাচাই করেছে নিউজবাংলা।
প্রাণিজগতে সাপ রেপটিলিয়া শ্রেণির স্কুয়ামাটা বর্গের একটি প্রাণী। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বলছে, বিশ্বে তিন হাজারেরও বেশি প্রজাতির সাপ রয়েছে। অ্যান্টার্কটিকা, গ্রিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড ছাড়া বিশ্বের সব জায়গাতেই কম-বেশি সাপের দেখা মেলে।
আর বিভিন্ন প্রজাতির সাপের প্রায় ৯৫ শতাংশই নির্বিষ। আর প্রায় সব জাতই কার্নিভোরাস বা মাংসাশী।
উপমহাদেশে সবচেয়ে পরিচিত ও বিষধর চার প্রজাতির সাপ হলো, গোখরা (Indian cobra- Naja naja), শঙ্খিনী বা কাল কেউটে (Common krait/Blue krait- Bungarus caeruleus), চন্দ্রবোড়া (Russell's viper- Daboia russelii) ও খুদে চন্দ্রবোড়া (saw-scaled viper- Echis carinatus)। এই চার প্রজাতির সাপই মাংসাশী।বিষধর বা নির্বিষ- যে ধরনের সাপই হোক না কেন, এই প্রাণীকে দুধ-কলা দিয়ে কি বশ মানানো সম্ভব?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একেবারেই সম্ভব নয়। বরং দুধ-কলা সাপের পছন্দের কোনো খাবারই নয়। এর মধ্যে অতি তৃষ্ণা পেলে এবং পানির কোনো উৎস না পেলে নিরুপায় হয়ে পানীয় হিসেবে সাপ হয়তো দুধে মুখ রাখতে পারে, তবে জোর করেও সাপকে কলা গেলানো প্রায় অসম্ভব।
লোককথা বা প্রচলিত বিশ্বাসে অনেক সময় গরুর খামারে সাপের লুকিয়ে দুধ খাওয়ার বিবরণ মেলে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈজ্ঞানিকভাবে এর কোনো ভিত্তি নেই। দুধ বা দুধজাতীয় খাবার হজম করতে পারে না সাপের পাকস্থলী।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল হাসান খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাপ মূলত কার্নিভোরাস। সে অন্য প্রাণী খায়, কলা তো খায়ই না। দুধ যেহেতু পানির মতো, সে হিসেবে সে খেতে পারে। তবে সাধারণত সে অন্য প্রাণী বা অন্য ছোট সাপ খায়। এ ছাড়া অন্য কোনো খাবার তার জন্য অস্বাভাবিক।’
গরুর ওলানে সাপের কামড় বা গরুর দুধ খাওয়ার গল্পেরও কোনো ভিত্তি নেই বলে জানান অধ্যাপক মনিরুল।
তিনি বলেন, ‘এগুলো ভ্রান্ত ধারণা। অনেক সময় গরুর বাটে পোকা কামড় দেয়। সেখান থেকে লোকে ধারণা করে যে সাপে কেটে গেছে।’
সাপের মাথায় মণি বা রত্নের বিষয়টিকেও কুসংস্কার বলছেন এই প্রাণিবিদ।
তিনি বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা। সাপের মণি বলে কিছু নেই। সাপের প্রতি মানুষের এক ধরনের কুসংস্কার আছে। সাপ অন্য প্রাণী থেকে একেবারেই ভিন্ন। কিছু সাপ বিষধর। যেগুলোর কামড়ে মানুষ মারা যায়।
‘যে কারণে আদিকাল থেকেই সাপ নিয়ে মানুষের মধ্যে কুসংস্কার আছে। সভ্য, শিক্ষিত হওয়ার পরেও কিছু মানুষের মধ্যে সেই ধারাটা এখনও আছে।’
পুরাণ বা লোকগল্পে যেমনটা বলা হয়, সাপ আসলে সে রকম ভয়ংকর বা খল চরিত্রের কোনো প্রাণী নয়। বরং অন্যান্য প্রাণীর মতোই এটিও মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে।
সাপ সম্বন্ধে কুসংস্কার ও আতঙ্ক দূর করে সঠিক তথ্য প্রচারে জোর দিচ্ছেন অধ্যাপক মনিরুল।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমে কুসংস্কার দূর করতে হবে। মানুষকে বাস্তব তথ্য জানাতে হবে। সাপের মধ্যে ৯৫ ভাগ নির্বিষ। এ তথ্যটা বেশির ভাগ মানুষ জানেন না বা এ নিয়ে সচেতন নন। বেশির ভাগ সাপ নির্বিষ আর সেগুলো চেনাও খুব কঠিন কাজ নয়।‘তাই এগুলো মারার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এ ছাড়া আইনি বিষয় আছে। বন্য প্রাণী আইন অনুযায়ী, যেকোনো বন্য প্রাণীকে ইচ্ছামতো ধরা বা মারা যায় না। এসব বিষয় সামনে নিয়ে আসতে হবে।’