সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়েও বিধিবহির্ভূতভাবে ১০ বছর বেতন নেয়া জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতালের চিকিৎসক ফাতেমা দোজার অনিয়মের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ে উপস্থিত হয়ে এরই মধ্যে কারণ ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। তাতে অবশ্য সন্তুষ্ট হয়নি সরকার। তিনি জমা দিতে পারেননি যথাযথ কাগজপত্র। তাই রোববার আবারও তাকে সশরীরে ডাকা হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ জানুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে উপস্থিত হন চিকিৎসক ফাতেমা দোজা। অনিয়মের বিষয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করেন। তবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তার বক্তব্যে সন্তুষ্ট না হওয়ায় কাগজপত্রসহ লিখিত জবাব দেয়ার জন্য মৌখিকভাবে সময় প্রার্থনা করেন এই চিকিৎসক।
তার পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কর্মকর্তারা ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে নিজের চাকরি নিয়ে সঠিক কোনো যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেননি তিনি। পরে আরও কিছুদিন সময় বাড়িয়ে রোববার ১২টার মধ্যে সশরীরে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। এমনকি, প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ প্রমাণ দাখিলেরও নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণলায়ের তদন্ত কমিটি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়ার আগে তদন্ত কর্মকর্তারা কয়েকটি বিষয় মাথায় রেখে কাজ করছেন: দশ বছরে চাকরি থেকে অব্যাহতি নেয়ার নথি কেন অধিদপ্তর থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পৌঁছাল না, কার সংশ্লিষ্টতায় অব্যহতির নথি উধাও হয়ে গেল।
এ ছাড়া ব্যাখ্যা চেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও দেয়া হবে একটি চিঠি। প্রতিষ্ঠানটির যে পরিচালকের কাছে এ চিকিৎসক অব্যাহতিপত্র দিয়েছেন, যার অনুমোদনে কার্যকর হয় অব্যাহতি পত্র, তার মূল্যায়ন জানতে চাওয়া হবে। সেই পরিচালকের অধীনে অব্যাহতি নেয়ার পরও আবার তিনি কীভাবে চাকরিতে ফিরে এলেন, তার উত্তরও খুঁজতে চায় তদন্ত কমিটি।
তদন্তের অগ্রগতি বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মাসুদ উজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখনও তদন্ত শেষ হয়নি। তদন্ত শেষ করে আমরা একটি রিপোর্ট জমা দিব। সেই রিপোর্টে শাস্তির বিষয় উল্লেখ করা হবে। তবে কেউ অপরাধ করলে অবশ্যই শাস্তি পাবেন আইন অনুযায়ী। দুই-একদিনের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতালে তদন্ত কমিটির টিম যাবে। তারা সরাসারি যে তথ্যপ্রমাণ পাবে, তা অনুয়ায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চাকরি থেকে অব্যহিত নেওয়ার পর এখনও কীভাবে চাকরি করছেন – এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় হদরোগ ইনস্টিটিউটের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল সাফী মজুমদার বলেন, তিনি অব্যাহতিপত্র গ্রহণ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক বরাবর দরখাস্ত দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেছিলেন।
আব্দুল্লাহ আল সাফী বলেন, ‘অনেক বছর আগের বিষয়। এখন আমি হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে আর চাকরি করি না। এ বিষয়ে আর খোঁজখবর রাখি না। (ডা. ফাতেমা দোজা) ইস্তফা দিয়ে বিএসএমএমইউতে চাকরি করে ফের কীভাবে হৃদরোগে এলেন, বলতে পারব না। বর্তমান পরিচালক এবং তার সহকর্মী যারা আছেন তাদের জিজ্ঞেস করেন। আমি তার অব্যাহতির জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বরাবর সুপারিশ করলেও এখন সঠিকভাবে মনে করতে পারছি না। আমি থাকাকালে তিনি পুনরায় যোগদান করছেন এমনটা হওয়ারও কথা না। যদি হয়ে থাকে, কাগজপত্র দেখলে বোঝা যাবে।’
এ বিষয়ে জানতে নিউজবাংলা কথা বলে ফাতেমা দোজার সঙ্গে। বিধিবহির্ভূতভাবে চাকরি ফিরে পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেন তিনি। এরপর একাধিকবার ফোন করলেও তা ধরেনি। এরপর নিউজবাংলার হাতে আসা তদন্ত কমিটির নোটিশ ফাতেমা দোজার হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো হলে তিনি তা দেখলেও কোনো জবাব দেননি।
অব্যাহতি নিয়েও ১০ বছর বেতন
সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়েও বিধিবহির্ভূতভাবে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতাল থেকে ১০ বছর ধরে বেতন, ভাতা, বোনাস নিচ্ছেন চিকিৎসক ফাতেমা দোজা।
২০০৭ সালে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতালে রেডিওলজিস্ট হিসেবে যোগ দেন তিনি। ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানটি থেকে অব্যাহতি নেন। এরপর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগে।
তবে ছয় মাস পর বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় চুক্তির মেয়াদ আর বাড়ায়নি। তবে অব্যাহতি নিলেও নিয়মবহির্ভূতভাবে পদোন্নতি নিয়ে তিনি ফিরে আসেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে।
যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, একবার সরকারি চাকরি ছাড়লে তা ফিরে পাওয়ার আর কোনো সুযোগ থাকে না। ফাতেমা দোজা তাহলে কীভাবে চাকরি ফিরে পেলেন এবং পদোন্নতি নিলেন, তা অবাক করছে অনেককে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও।
দুটি প্রতিষ্ঠানে ফাতেমা দোজার নিয়োগপত্র, পদোন্নতি, অব্যাহতিসহ বিভিন্ন তথ্যের কাগজের কপি এসেছে নিউজবাংলার হাতে।
এসব কাগজ থেকে জানা যায়, ফাতেমা দোজা ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ২০০৭ সালে তিনি রেডিওলজিস্ট পদে জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে যোগ দেন। ২০০৯ সালে পদ পরিবর্তন করে তিনি মেডিক্যাল অফিসার পদে যোগ দেন। এই পদে কর্মরত ছিলেন ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
এরপর স্বায়ত্তশাসিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে অস্থায়ী ভিত্তিতে ছয় মাসের জন্য নিয়োগ পান।
সেখানে যোগ দিতে ২২ ফেব্রুয়ারি সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য সচিব বরাবর লিখিত আবেদন করেন। আবেদন পরিচালক জমা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।
সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষে বিএসএমএমইউতে যোগ দেন ডা. ফাতেমা দোজা। তবে ছয় মাস পর তার চাকরিটি স্থায়ী করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ সময় তিনি বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালেও প্র্যাকটিস করতেন। অভিযোগ রয়েছে, বিএসএমএমইউতে চুক্তিভিত্তিক চাকরি স্থায়ী না হওয়ার কারণে বিভিন্ন পর্যায়ে তদবিরের মাধ্যমে আবার হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ফিরে আসেন ফাতেমা। পদোন্নতিসহ নিচ্ছেন নিয়মিত বেতন-ভাতা।