শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হলে দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একযোগে পদত্যাগ করবেন বলে গুঞ্জন ছড়িয়েছে ফেসবুকে।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫০। এর মধ্যে ৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একযোগে পদত্যাগের হুমকি দিয়েছেন বলে তথ্য প্রচার হচ্ছে ফেসবুকে।
এই তথ্যের ভিত্তি কী, তা অনুসন্ধান করেছে নিউজবাংলা। এতে দেখা গেছে, একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসের ভিত্তিতে এ-সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে একটি সংবাদমাধ্যম। আর তার পরই এ ধরনের তথ্য শেয়ার শুরু করেন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা।
উন্নয়নকর্মী ও কলাম লেখক শরিফুল হাসান তার ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টে শনিবার বিকেলে লিখেছেন, ‘৩৪ জন একযোগে পদত্যাগ করলে এই জাতি খুব খুশি হবে। কিন্তু ৩৪ জন তো দূরের কথা, একজনও পদত্যাগ করবেন না। বরং যেকোনো মূল্যে পদে থাকতে এরা কী করেন, সেটা আমরা বছরের পর বছর ধরে দেখে আসছি। এদের মতো আত্মমর্যাদাহীন খুব কম আছে। মর্যাদা থাকলে এরা নিজেরাই চলে যেতেন!’
একযোগে উপাচার্যদের পদত্যাগের হুমকির তথ্যের উৎস জানতে চাইলে শরিফুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন সাংবাদিক সুপন রায়। এরপর সেই স্ট্যাটাসের ভিত্তিতে আমাদের সময় ডটকম শুক্রবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সুপন রায়ের স্ট্যাটাস ও আমাদের সময় ডটকমের প্রতিবেদনের পরই এ বিষয়ে আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে।
ফেসবুকে সাংবাদিক সুপন রায়ের স্ট্যাটাস
সাংবাদিক সুপন রায় ফেসবুকে এ স্ট্যাটাসটি দেন বৃহস্পতিবার রাত ৮টা ৫০ মিনিটে। এতে তিনি লেখেন, ‘৩৪ উপাচার্য এক হয়ে বললেন, দরকার হলে একযোগে পদত্যাগ করবেন! প্রচণ্ড অস্বস্তিতে আছেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সভায় আজ ৩৪ উপাচার্য একত্রে বসেছেন। বক্তব্য রেখেছেন ২২ জন। সম্মানজনক সমাধান জরুরি।’
সুপন রায়ের এই স্ট্যাটাসের ভিত্তিতে কয়েক ঘণ্টা পর রাত ১২টা ২৯ মিনিটে ‘সুপন রায়: ৩৪ উপাচার্য এক হয়ে বললেন, দরকার হলে একযোগে পদত্যাগ করব!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আমাদের সময় ডটকম। এই প্রতিবেদনে সুপন রায়ের স্ট্যাটাস হুবহু তুলে ধরা হয়েছে, তবে সংশ্লিষ্ট কারও বক্তব্য এতে নেই।
সুপন রায়ের স্ট্যাটাসের ভিত্তিতে আমাদের সময় ডটকমে প্রকাশিত প্রতিবেদন
এর পরই বিষয়টি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমধ্যমে। সংবাদকর্মী মুকিমুল আহসান হিমেল ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘৩৪ জন ফরিদ নাকি এক হয়েছিলেন ভার্চুয়ালি। ঐতিহাসিক এই ফরিদ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত- পদত্যাগ করতে হলে ৩৪ জন উপাচার্য একসাথেই করবেন। সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা ফরিদের তরে!’
কাজল দাস নামে একজন লিখেছেন, ‘কত বড় কালপ্রিটরা এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয় চালায় দেখেন। ৩৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বলেছেন, সাস্টের ভিসির পদত্যাগের প্রয়োজন নেই। দরকার হলে তারা একযোগে পদত্যাগ করবেন। কীভাবে এরা ছাত্রদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছেন, একবার ভাবেন। দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এখন আন্দোলনে নামা উচিত। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চাল, ডাল কিংবা গার্মেন্টস মালিকদের সিন্ডিকেইটবাজির বিষয় নয়। এইসব মাফিয়া ভিসির হাত থেকে ক্যাম্পাস সুরক্ষা করতে গণজোয়ারের বিকল্প নেই।’
রাজু নুরুল নামে একজন লিখেছেন, ‘শাহজালালের ভিসিকে পদত্যাগ করতে হলে নাকি ৩৪ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি একযোগে পদত্যাগ করবেন। এটা শোনার পর থেকে আমি শুধু নিলুফার ইয়াসমিনের গাওয়া সেই গানটাই বারবার শুনছি- এত সুখ সইবো কেমন করে...’
৩৪ উপাচার্যের একযোগে পদত্যাগের গুজব ছড়িয়েছে ফেসবুকে
তবে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের দাবি, এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত বা অবস্থান তারা নেননি।
উপাচার্যদের বৈঠক সম্পর্কে জানতে চাইলে গাজীপুরের ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে একটি ভার্চুয়াল মিটিং হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে ৩৪ জন উপাচার্য একযোগে পদত্যাগের হুমকি বা এ বিষয়ে কোনো আলাপ-আলোচনা হয়নি।’
ফেসবুকে ছড়ানো তথ্যের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এটা সম্পূর্ণ গুজব, মিথ্যা ও বানোয়াট।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. মুনাজ আহমেদ নূর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি ওই বৈঠকে ছিলাম। তবে এমন কোনো সিদ্ধান্তের কথা আমার জানা নেই।’
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মশিউর রহমানও ছিলেন ওই বৈঠকে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নানা বিষয়ে আমাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল কি পরশু বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের একটি সভা হয়েছিল। তবে আমি মিটিংয়ের একদম শেষে জয়েন করেছি।’
৩৪ উপাচার্যের পদত্যাগ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছু শুনিনি। সবার শেষে জয়েন করাতে অনেকের বক্তব্যও শুনতে পাইনি।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি কোনো মিটিংয়ে ছিলাম না। এমন কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমি জানি না। বৈঠকে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত হলে তো আমাকে জানানো হতো।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সত্যপ্রসাদ মজুমদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি সভার আমন্ত্রণ পেয়েছি। তবে অসুস্থ থাকায় উপস্থিত ছিলাম না।’
সংবাদিক সুপন রায় কোন উৎস থেকে এমন তথ্য পেলেন তা জানার চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা। তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। তার ফেসবুক মেসেঞ্জারে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।