শীত-গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষা, ব্রহ্মপুত্রের তীর ঘেঁষা কুড়িগ্রামের যাত্রাপুর হাটে সবসময় লেগে থাকে মানুষের ভিড়। রংপুর বিভাগের অন্যতম বৃহৎ এই হাটের ক্রেতা-বিক্রেতারদের প্রধান বাহন নৌকা। হাটের পাশেই ঘাটে থাকে হাজারো নৌকার ভিড়।
স্থানীয়রা জানান, যাত্রাপুরে হাটের দিন এক হাজার থেকে দেড় হাজার নৌকা ভিড় জমায়। যাত্রী, মাঝি আর দোকানিদের হাঁকডাকে জমজমাট থাকে যাত্রাপুর ঘাট। এই হাট হয়ে উঠেছে উত্তরাঞ্চল এলাকার কয়েক হাজার মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের কালিরআলগারচর গ্রামের বাসিন্দা ইউসুফ আলী। এই হাটে ৩৫-৪০ বছর ধরে নৌকার মাঝির কাজ করছেন। কিশোর বয়সে বাবার সঙ্গে নৌকার হাল ধরেন তিনি।
ধার-দেনা আর এনজিওর ঋণে এখন সাড়ে ৩ লাখ টাকা দামের নৌকার মালিক ইউসুফ। সেই নৌকার আয়েই চলছে তার বিলাসহীন জীবন।
ইউসুফ জানালেন, প্রতি হাটেই এ ঘাটে এক হাজারের বেশি নৌকা নোঙর হয়, যা বৃহত্তর রংপুর বিভাগের কোনো ঘাটে নেই। যাত্রাপুর ঘাটে নানা আকারের, নানা রঙের নৌকা আসে। এর মধ্যে রয়েছে মাছ ধরার ডিঙি নৌকা সঙ্গে পণ্যবাহী বড় বড় মহাজনী নৌকাও।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদ ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছে যে চরের পাশ দিয়ে, তার নাম অষ্টআশির চর। ওপারে ভারতের আসাম রাজ্যের ছালাপাড়া, তিন শ বিঘা, বুদাখার হাট। বৃটিশ আমলে এই নৌ পথ দিয়ে ভারতের সঙ্গে চলতো ব্যবসা-বাণিজ্য। দেশ ভাগ আর নদ-নদীর পানি কমে যাওয়ায় নৌ পথের ব্যবসা বন্ধ হয়েছে কয়েক দশক আগেই।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ও মালামাল নিয়ে ভারতের মানুষজন আসতো যাত্রাপুর হাটে। সেদিন ফুরিয়েছে অনেক আগে। এখন এই হাট চলে আশপাশের চরবাসীদের কেন্দ্র করেই।
ভগবতীর চর, ইটালুকান্দা, ফকিরেরচর, দৈ-খাওয়া, আইরমারী, সাহেবের আলগা, জাহাজের আলগা, ঝুনকারচর, কালিরআলগা, রলাকাটা, নারায়ণপুর, বারোবিশ, চরকাঁপনা, নুন খাওয়া, শান্তিয়ার চর, মাদারগঞ্জ, কচাকাটা, শৌলমারীসহ ছোট-বড় আড়াই শতাধিক চর থেকে মালামাল ও যাত্রী আনা-নেয়ার কাজ করেন মাঝিরা।
ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার তীরের এসব চর এলাকায় সড়ক যোগাযোগ নেই। চরাঞ্চলবাসীর চলাচলের একমাত্র ভরসা নৌকা। তাই যাত্রাপুর হাটে আসা নৌকাগুলো থাকে মানুষ আর মালপত্রে ভরা।
যাত্রাপুর হাটের বেশির ভাগ দোকানদারই অস্থায়ী ও মৌসুমী। ঘাটেই বসান পণ্যের পসরা। সপ্তাহে দুদিন এখানে হাট বসে, শনিবার আর মঙ্গলবার। এই দুদিন থাকে মানুষ ও নৌকার ভিড়ও।
যাত্রাপুর হাটে নৌকায় করে আসছেন আশপাশের চরবাসীরা। ছবি: নিউজবাংলা
চরাঞ্চলের গরু, ছাগল, মহিষসহ গবাদি পশু এবং ধান, পাট, কাউন, চিনাবাদাম, ডাল, কলাসহ নানা কৃষিপণ্য নিয়ে চরের মানুষ আসে যাত্রাপুর হাটে। কেনা-বেচা শেষে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায় এসব পণ্য। শুকনা মৌসুমে প্রায় দেড়-দু কিলোমিটার চর ভেঙে ধুলায় মাখামাখি হয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার দল ছোটে ঘাটে-হাটে।
ইউসুফ আলী জানান, এই ঘাটে প্রায় ৩০-৩৫ বছর বয়স থেকে নাইয়ার কাজ করেন তিনি। আগে নৌকা চালিয়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় হলেও বর্তমানে ১ হাজার থেকে ১২ শ টাকা আয় হয়। তবে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ও নদ-নদীর পানি কমে যাওয়ায় নদী পথ ঘুরতে হয় বেশি। ফলে আয় বাড়লেও পুষিয়ে ওঠা যায় না।
যাত্রাপুর হাটের মাঝি সমেশ আলী বলেন, ‘নাও চালেয়া জীবন কাটে। চরের মধ্যে কোনো কাম কাইজ নাই। এই নাও চালালে ১০ টাকা পাইলে ওডাই হামার লাভ। কামলাও তো দিবার যাবার পারিন্ন্যা। নৌকা আগের থেইক্যা মেলা বাড়ছে। একেক জনের বাড়িতে অন্তত দুইডা করি আছে।’
মোল্লারচরের মাঝি মোস্তাকিন মিয়া বলেন, ‘আগে মনে করেন নৌকা ছিল পাঁচ শ, ছয় শ। আর এখন প্রায় ছোট-বড় মিলায়ে দেড় হাজার হইব। এই নৌকা চালায়ে মাছ-টাছ ধরি খাই। আল্লাহ যা আয় উন্নতি দিছে তাতে ভালই চলে। এই আয় থেইক্যা কিছু খাই, কিছু জমাই। তাই দিয়ে কৃষি কামকাইজ করি চলছি।’
বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মোল্লারহাট গ্রামের বাসিন্দা গোলজার হোসেন তুলে ধরলেন এই নদী পথের অতীত। তিনি জানান, বৃটিশদের সময় চর যাত্রাপুর গ্রামের উত্তরে ছিল ব্রহ্মপুত্র নদ। নদের পারেই যাত্রাপুর ঘাট। দক্ষিণে কুড়িগ্রাম শহর হয়ে ট্রেন আসত রেল বাজার স্টেশনে। দেশ স্বাধীনের পর রেল গাড়ি বন্ধ হয়ে গেলেও রেল বাজারের চর নামেই মানুষ এই এলাকা চেনে।
তিনি বলেন, ঘাটের পাশেই ছিল বিশাল আকারের বটগাছ। সেই গাছের গোড়ায় বসত গানের আসর। ব্রহ্মপুত্রের থাবায় এখন এসব শুধুই স্মৃতি। এখন বর্ষায় একেবারে হাটের কিনারে সরে আসে যাত্রাপুর ঘাট। শত শত নৌকা আসে ব্রহ্মপুত্রের বুকে ঢেউ খেলিয়ে। যাত্রাপুরের হাট বসে সপ্তাহে শনিবার এবং মঙ্গলবার। সেই হাট ধরার জন্য আগে চড়ায়ারা শুকনা খাবার বা ভাত নিয়ে ঠ্যালা নাও নিয়া আগের দিন বের হতো। হাট শেষ করে ফিরতে হতো পরের দিন।
হাটকে কেন্দ্র করে চরাঞ্চলবাসীর শত-শত নৌকা ভিড় হয় যাত্রাপুর ঘাটে। ছবি: নিউজবাংলা
মজিবর রহমান মাঝি বলেন, ‘আমি ৪৭ হাত লম্বা একটি নৌকায় বানাইছি। মিস্ত্রি, লোহাসহ প্রায় ৩ লাখ টাকা খরচ গেছে। আগে সপ্তাহে আসতো পাঁচ-ছয় হাজার টাকা। আর এখন নৌকা বেশি হওয়ায় আসে দু’হাজার টাকা।’
যাত্রাপুর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য রহিম আহমেদ বলেন, উত্তরাঞ্চরের মধ্যে সবচেয়ে বড় হাট হলো যাত্রাপুরের হাট। এই হাটকে কেন্দ্র করে চরাঞ্চলবাসীর শত-শত নৌকা ভিড় হয় যাত্রাপুর ঘাটে। চরের মানুষের আয়ের প্রধান উৎস নৌকা আর কৃষি। প্রতি হাটে পণ্য আর যাত্রীর ভিড় বাড়ে ঘাটে। চরে উৎপাদিত ধান, পাট, কাউন, ডাল, চিনা বাদাম,কলাসহ কৃষিপণ্য নিয়ে চরের মানুষ আসে হাটে। চর থেকে গরু-মহিষ, ছাগল, হাঁস, মুরগিসহ মালামাল নৌকায় আসে।