সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রতি একটি ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, রাজধানীতে এক চীনা নাগরিক ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়েছেন। এক পর্যায়ে ‘তুমি টাকা চাও, এই নাও টাকা’ বলে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের দিকে টাকা ছুড়ে মারেন তিনি।
কী ঘটেছিল, কেন ওই বিদেশি ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশের দিকে টাকা ছুড়ে মারেন- সেসব প্রশ্নের জবাব খুঁজেছে নিউজবাংলা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘটনাটি মঙ্গলবার বিকেলের। আর ঘটনাস্থল মহাখালী রাওয়া ক্লাব সংলগ্ন ফ্লাইওভারের নিচে ট্রাফিক পুলিশ বক্সের পাশে।
ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা যায়, রাওয়া ক্লাবের পাশ দিয়ে একটি সড়ক গেছে মহাখালী ডিওএইচএসের দিকে। ডিওএইচএস থেকে আসা গাড়িগুলো যাওয়ার জন্য এই পয়েন্টে জাহাঙ্গীর গেট থেকে আসা গাড়ির সারিকে কিছু সময় পর পর সিগন্যাল দিয়ে থামানো হয়।
এই সিগন্যালে যান নিয়ন্ত্রণ ও গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা করতে পুলিশের একাধিক সদস্য নিয়োজিত। পাশেই রয়েছে শেরে বাংলানগর ট্রাফিকের পুলিশ বক্স।
প্রত্যক্ষদর্শীরা নিউজবাংলাকে জানান, মঙ্গলবার বিকেলে নিয়মিত চেকের অংশ হিসেবে একটি প্রাইভেটকার থামান কনস্টেবল রুহুল আমিন খান। চালকের কাছ থেকে গাড়ির কাগজ নিয়ে যাচাই করতে নিয়ে যান পাশেই দায়িত্বপালনরত টিএসআই হারুন অর রশীদ সরকারের কাছে।
গাড়ি থামিয়ে চালকের কাছ থেকে কাগজ নেয়া, যাচাই করার জন্য টিএসআইয়ের কাছে যাওয়া এবং সেগুলো ফেরত দেয়া পর্যন্ত কিছুটা সময় লেগেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পথচারী বলেন, ‘এর মাঝেই হঠাৎ গাড়ি থেকে নেমে আসেন একজন বিদেশি। তিনি তাড়া দিচ্ছিলেন। তার চালককে কাগজগুলো ফিরিয়ে দিয়ে যেন যেতে দেয়া হয়। তবে পুলিশ কাগজপত্র চেক করতে সময় নিচ্ছিল।’
এই পথচারী বলেন, ‘আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কী কথা হচ্ছিল তা বোঝা যাচ্ছিল না। বিদেশি ভদ্রলোক যখন চিৎকার শুরু করেন, আমরা এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি, উনি পুলিশের সঙ্গে রাগারাগি করছেন। এক পর্যায়ে টাকা ছুড়ে দেন পুলিশের দিকে।’
চীনা নাগরিকের ওই চিৎকার ও টাকা ছুড়ে মারার দৃশ্যটি মোবাইল ফোনে ভিডিও করেন স্যাম আহমেদ নামে একজন ব্যক্তি। এরপর তিনি ভিডিওটি বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করেন।
স্যাম পোস্টের বিবরণে লিখেন, “গতকাল রাওয়া ক্লাব এর সামনে এই সাদা রঙের গাড়িতে থাকা বিদেশিদের দেখে ট্রাফিক পুলিশের মাথা নষ্ট হয়ে যায়৷ সব কাগজপত্র ঠিক থাকা সত্ত্বেও ড্রাইভারকে লেইম একটা অজুহাত দেখিয়ে যখন টাকা দাবি করলো তখন বিদেশি ভদ্রলোকটি পুলিশকে অনুরোধ করে বলেন, ‘HE IS A POOR MAN PLEASE DON DO THIS’. কে শোনে কার কথা টাকা দিতেই হবে না হলে কাগজপত্র দেবে না মামলা ছাড়া। অতঃপর বিদেশি ভদ্রলোকটি পুলিশের মুখে টাকা ছুড়ে মেরে ড্রাইভারকে বাঁচিয়ে নেয় পুলিশের হাত থেকে।”
তবে নিউজবাংলার পক্ষ থেকে স্যামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, পোস্টে তিনি পুলিশের টাকা দাবির অভিযোগ তুললেও বিষয়টি তিনি নিজে দেখেননি বা কারও কাছ থেকে শোনেননি। ধারণা থেকেই তিনি টাকা দাবির অভিযোগ তুলেছেন।
স্যাম বলেন, ‘টাকা না চাইলে তো চাইনিজ লোকটা টাকা ছুড়ে মারতো না।’
চীনা নাগরিকের ক্ষেপে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশ ড্রাইভারকে পাশে থাকা বক্সে যাওয়ার জন্য বলছিল। কিন্তু চাইনিজ নাগরিক তার ড্রাইভারকে দ্রুত ছাড়িয়ে নিতে চাইছিলেন। তার হয়ত তাড়া ছিল, সেজন্য ক্ষেপেছেন মনে হয়।’
স্যাম পরে তার পোস্টগুলো সরিয়ে নেন। তবে এর আগেই ভিডিওটি ডাউনলোড করে আরও অনেকে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন।
ঘটনাস্থলের ১০ গজের মধ্যে ছিলেন সিগারেট বিক্রেতা ফজলুল হক। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পুলিশ কোনো টাকা চায়নি। কাগজ দেখতেছিল। বিদেশি হুদাই চিল্লাইছে। উল্টা উনি পুলিশের সাথে খারাপ ব্যবহার করছে।’
চীনা নাগরিক যে প্রাইভেটকারে ছিলেন তার চালক রফিকুল ইসলামের সঙ্গেও কথা বলেছে নিউজবাংলা। পুরো বিষয়টি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে দাবি করে রফিক বলেন, ‘ছোট একটা ঘটনা, এটারে অন্যরা এতো বড় বানাইছে। একটা ভুল বোঝাবুঝি হইছে। এই বাইরে কিছু হয় নাই।’
নিউজবাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই চীনা নাগরিক ঢাকার একটি বায়িং হাউজে কর্মরত।
ঘটনা নিয়ে যা বলছে ট্রাফিক পুলিশ
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিউজবাংলাকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি নজরে আসতেই তদন্ত শুরু করা হয়েছে। তদন্তের অংশ হিসেবে ওই দিনই দায়িত্বে থাকা কনস্টেবল রুহুল আমিন খান ও টিএসআই হারুন অর রশীদ সরকারকে ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগের উপ কমিশনারের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।
তবে এখন পর্যন্ত ট্রাফিক পুলিশের দায় পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
ট্রাফিক তেজগাঁও বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক-শেরে বাংলানগর জোন) শোভন চন্দ্র হোড় প্রাইভেটকার চালকের বরাত দিয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশ নরমালি গাড়ি থামিয়ে কাগজ চেক করছিল। ওই ফরেইনার যে গাড়িতে ছিলেন সেটা থামান একজন কনস্টেবল। থামিয়ে চালকের কাছ থেকে কাগজগুলো নেন।
‘এরপর কাগজগুলো যাচাই করার জন্য ওখানে দায়িত্বে থাকা টিএসআই এর কাছে নিয়ে যান। টিএসআই হারুন অর রশীদ তখন অন্য আরেকটি গাড়ির কাগজ চেক করছিলেন। যে কারণে ওই গাড়ির কাগজটি চেক করতে দেরি হয়। আর তখনই গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন চীনা নাগরিক। চিৎকার শুরু করেন। টাকা ছুড়ে মারেন।’
গাড়ি চালকের কাছে কোনো টাকা চাওয়া হয়নি বলে জানান শোভন চন্দ্র হোড়। তিনি বলেন, ‘টাকা চাইলে চালকের কাছে চাইত। কিন্তু চালক বলছে তার কাছে কোনো টাকা চাওয়া হয়নি। চীনা নাগরিকের কোনো একটি মিটিং ছিল। চেকিংয়ের কারণে তার হয়তো দেরি হচ্ছিল। যে কারণে তিনি উত্তেজিত হয়ে যান। ভেবেছেন টাকার জন্য আটকে রাখছে। যেটা মোটেও ঠিক না। একটি গাড়ি থামানো থেকে শুরু করে চেক করে কাগজগুলো ব্যাক করতে একটা সময় প্রয়োজন হয়। সেই সময়টুকু চীনা নাগরিক দিতে চাননি।’
তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) সাহেদ আল মাসুদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ঘটনাটি জানার পরই তদন্ত শুরু করি। প্রতিটি পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। আমাদের দুই সদস্যের কোনো অপরাধ পাইনি। এরপরেও তদন্তের স্বার্থে তাদেরকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে ডিসি কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়েছে।
‘এছাড়া গাড়ি চালক ও চীনা নাগরিকের সঙ্গেও আমাদের কথা হয়েছে। চালকের কাছে আমাদের ট্রাফিক সদস্যরা কোনো টাকা দাবি করেননি। এমনকি চীনা নাগরিকের সঙ্গেও আমাদের সদস্যদের কোনো কথা হয়নি। উনি ধারণা করেছিলেন, টাকার জন্য হয়ত আটকিয়েছে। এই ধারণা থেকে তিনি এমন আচরণ করেছেন।’
এমন আচরণের জন্য চীনা ওই নাগরিক ক্ষমা চেয়েছেন বলে জানান সাহেদ আল মাসুদ। তিনি বলেন, ‘ফোনে ওই চীনা নাগরিকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি এমন আচরণের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। তার প্রতিক্রিয়া এভাবে ভাইরাল হয়ে যাবে এমনটি বুঝতে পারনেনি এবং এ ধরনের কোনো ইনটেনশন তার ছিল না বলেও জানিয়েছেন।’