মায়ের কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন তুমুল পাঠকপ্রিয় থ্রিলার সিরিজ মাসুদ রানা ও কুয়াশা সিরিজের স্রষ্টা এবং সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার কাজী আনোয়ার হোসেন।
বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটার দিকে রাজধানীর বনানী কবরস্থানে মা সাজেদা খাতুনের কবরে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
এর আগে সেগুনবাগিচার কাঁচাবাজার মসজিদে বাদ জোহর কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
সকাল সোয়া ৯টার দিকে বারডেম হাসপাতালের হিমঘর থেকে মরদেহ সেগুনবাগিচায় তার বাসায় নেওয়া হয়।
প্রতিবেশী ও সংবাদকর্মীরা সেখানে লেখককে শেষবারের মতো দেখতে গেলেও অন্য লেখক বা প্রকাশকদের তেমন দেখা যায়নি।
বনানী কবরস্থানে মায়ের কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় কাজী আনোয়ার হোসেনকে। ছবি: নিউজবাংলাকাজী আনোয়ার হোসেনের চাচাতো ভাই কাজী রওনাক হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা একটা বিরাট ইতিহাসের অংশ হারালাম। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো ওনার মূল্যায়ন সেভাবে হয়নি। যখন কম্পিউটার ছিল না, মোবাইল ছিল না, অ্যাপস ছিল না সেই সময়ে এ দেশের যুব সমাজকে অবক্ষয় থেকে রোধ করেছিল মাসুদ রানা এবং কুয়াশা।
‘অবাক হবেন, যারা শোকবার্তা পাঠাচ্ছেন, তারা লিখছেন, কেউ হয়তো ২০ বছর বয়সে মাসুদ রানা পড়েছেন এখন তার বয়স ৬০ বা ৬৫। তার জীবনটা পুরো প্রভাবিত মাসুদ রানা চরিত্রটি দিয়ে।’
রওনাক জানান, কাজী আনোয়ার হোসেন অত্যন্ত ভালো কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। উনি সিনেমায় গানও গেয়েছেন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত রেডিওতে নিয়মিত নজরুলসংগীত, আধুনিক গান করতেন। সৈয়দ শামসুল হকের কথায় সত্য সাহার সুরে, আব্দুল আলীমের সঙ্গে ‘এই যে আকাশ, এই যে বাতাস’ গেয়েছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। উর্দু তালাশ সিনেমাতেও গান করেছেন তিনি।
মূল্যায়ন না হওয়ার বিষয়ে রওনাক হোসেন বলেন, ‘দেশের জন্য, যুব সমাজের জন্য যিনি এতকিছু করে গেলেন সরকারের থেকে কোনো রকম স্বীকৃতি নেই। তিনি সব সময় নিভৃতচারী ছিলেন, কখনই চাননি তাকে ঢাকঢোল পিটিয়ে পদক দেয়া হোক।
‘আমি মনে করি দেশ-জাতি, সরকারের একটা কর্তব্য আছে। বাংলা একাডেমি সাহিত্যের জন্য যাদের পুরস্কার দিচ্ছে, ওনার যোগ্যতা কি তাদের চেয়ে কম? এই জিনিসগুলো নিয়ে একটু কষ্ট পাই।’
কাজী আনোয়ার হোসেন প্রোস্টেট ক্যানসারে ভুগছিলেন। বুধবার বিকাল ৪টা ৪০ মিনিটে বারডেম হাসপাতালে মারা যান তিনি।
সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার হিসেবে কাজী আনোয়ার হোসেন ষাটের দশকের মধ্যভাগে মাসুদ রানা নামের স্পাই চরিত্র সৃষ্টি করেন। মাসুদ রানার চরিত্রটি মূলত ইয়ান ফ্লেমিংয়ের সৃষ্ট জেমস বন্ড চরিত্রের বাঙালি সংস্করণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
মাসুদ রানা সৃষ্টির কিছু আগে কুয়াশা নামক আরেকটি জনপ্রিয় চরিত্র তার হাতেই জন্ম নেয়। কাজী আনোয়ার হোসেন ছদ্মনাম হিসেবে বিদ্যুৎ মিত্র ও শামসুদ্দীন নওয়াব নাম দুটি ব্যবহার করতেন। তবে সেবা প্রকাশনীর ভক্ত পাঠকের কাছে তিনি কাজীদা নামেই বেশি পরিচিতি পান।
কাজী আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৯ জুলাই ঢাকায়। পুরো নাম কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন। ডাক নাম ‘নবাব’। তার বাবা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন, মা সাজেদা খাতুন।
কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯৫২ সালে সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ এবং বিএ পাস করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করেন তিনি।
বেশ কয়েক বছর রেডিওতে নিয়মিত গান গাইতেন কাজী আনোয়ার হোসেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বেতারের সংগীতশিল্পী ছিলেন। ১৯৬২ সালে বিয়ে করেন কণ্ঠশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিনকে।
কাজী আনোয়ার হোসেনের তিন বোন সনজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন ও মাহমুদা খাতুনও রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী।
কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯৬৩ সালের মে মাসে বাবার দেয়া ১০ হাজার টাকা নিয়ে সেগুনবাগিচায় প্রেস চালু করেন। দুজন কর্মচারী নিয়ে শুরু হওয়া এই প্রেসের নাম পরে পাল্টে হয় সেবা প্রকাশনী। সেবা প্রকাশনী বাংলাদেশে পেপারব্যাক বই প্রকাশ, বিশ্ব সাহিত্যের প্রখ্যাত উপন্যাসের অনুবাদ এবং কিশোর সাহিত্যের ধারা এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।