ময়মনসিংহের সড়কগুলোতে প্রতিদিন ছোটাছুটি করা যানবাহনগুলোর বেশির ভাগই ফিটনেসহীন। এমনকি মহাসড়কেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গাড়িগুলো। ওই অঞ্চলে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণও এসব গাড়ি। তবে এ বিষয়ে নির্বিকার সবাই।
নাগরিক আন্দোলনের নেতারা বলছেন, বিআরটিএ ও প্রশাসনের সঙ্গে পরিবহন নেতাদের যোগসাজশে ময়মনসিংহজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ফিটনেসহীন গাড়ি।
তারা জানান, এ বিভাগের অধীন চারটি জেলার সব যানবাহন চলাচল করে ময়মনসিংহ নগরীর ভেতর দিয়ে। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি ও চালকদের খামখেয়ালিপনার কারণে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে।
এসব দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে ফিটনেসহীন যানবাহনকে। অদৃশ্য কারণে নেয়া হচ্ছে না এসব গাড়িসহ মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচল বন্ধ করার উদ্যোগ। ফলে গাড়ি চলাচলে হযবরল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে ময়মনসিংহে। এতে জনদুর্ভোগ পৌঁছেছে চরমে।
স্থানীয় বিআরটিএ কার্যালয় থেকে জানা যায়, ময়মনসিংহ জেলায় বিআরটিএ কর্তৃক নিবন্ধনকৃত যানবাহনের সংখ্যা ৮ হাজার ১৩৬টি। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৭৪টি যানবাহন রাজস্ব জমা দিয়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট নিয়েছে।
বর্তমানে ফিটনেসহীন ৬ হাজার ৫০২টি যানবাহন চলাচল করছে। এই হিসাবে ময়মনসিংহে ৭৯ দশমিক ৯২ শতাংশ যানবাহন ফিটনেসহীন হয়েও যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে।
যাত্রীদের অভিযোগ, মালিকরা নিজের স্বার্থে ফিটনেসবিহীন যানবাহন মহাসড়কে নামিয়েছেন। আর এসব বন্ধে রয়েছে বিআরটিএ ও প্রশাসনের গাফিলতি। ট্রাফিক পুলিশেরও আয়ের উৎসে পরিণত হয়েছে ফিটনেসহীন গাড়িগুলো। প্রতিটি গাড়ি থেকেই হাত বাড়িয়ে টাকা নিচ্ছেন তারা। মামলা না দেয়ায় সরকারও পাচ্ছে না রাজস্ব। এসব গাড়িতে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়।
নগরীর পাটগুদাম বাস টার্মিনালে কথা হয় খোকন নামের একজন বাসযাত্রীর সঙ্গে। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি গাজীপুরে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করি। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের তারাকান্দায় ছুটি কাটিয়ে আবারও কাজে যাচ্ছি। আসা-যাওয়ার সময় কোনটা ঝুঁকিপূর্ণ গাড়ি, আমাদের বোঝার উপায় নেই। অনেক গাড়ির ছাল চামড়া না থাকলেও আমরা বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করছি।’
আসাদ নামে আরেকজন যাত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু জনগণের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। নয়তো সড়কে আরও বহু মানুষের প্রাণ ঝরবে।’
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, জেলায় ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে ১৫৩টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৫৬ জন। এই সময়ে আহত হয়েছেন অন্তত ১৭৯ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ত্রিশাল ও ভালুকা উপজেলায়।
জেলা নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার নুরুল আমিন কালাম বলেন, ‘ফিটনেসহীন যানবাহন বন্ধ করতে আমরা অনেকবার সংশ্লিষ্টদের বলেছি। তবে কার্যত ফলাফল শূন্য। কার প্রয়োজনে এসব গাড়ি চলাচল অব্যাহত আছে, তা জনসমক্ষে পরিষ্কার করা প্রয়োজন। আমরা মনে করি, ওপরে ঠিকঠাক ভেতরে সদরঘাট- এমন গাড়ি থাকার চেয়ে না থাকা ভালো।’
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের (নিসকা) জেলা শাখার সভাপতি আব্দুল কাদের চৌধুরী মুন্না জানান, বিআরটিএ, প্রশাসন ও পরিবহন নেতাদের যোগসাজশে এসব গাড়ি রাস্তায় চলছে। পাশাপাশি রয়েছে অনেক অদক্ষ চালক। ফলে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে।
তিনি বলেন, সড়কে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ফিটনেসহীন যান চলাচল বন্ধ করার পাশাপাশি থ্রি-হুইলার মহাসড়কে চলাচল বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া চালকদের সচেতনতার মাধ্যমে গাড়ির গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
জেলা মোটর মালিক সমিতির সভাপতি মমতাজ উদ্দিন বলেন, করোনার কারণে যানবাহন মালিকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এখনও ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায়নি। এ কারণে অনেক মালিক রাজস্ব জমা দিয়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট নিতে পারেনি। বর্তমানে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা কমাতে মালিকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।
বিআরটিএ থেকে ফিটনেসহীন যানবাহনের তালিকা নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন ময়মনসিংহ ট্রাফিক বিভাগের পুলিশ পরিদর্শক (প্রশাসক) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
তিনি বলেন, সড়কে যানবাহনের ফিটনেসসহ অন্য কাগজপত্র কড়াকড়িভাবে তল্লাশি করা হবে। ঠিকঠাক ফিটনেসসহ সবকিছু ঠিক না থাকলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ময়মনসিংহের সহকারী পরিচালক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন নিউজবাংলাকে জানান, সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হচ্ছে ফিটনেসহীন যানবাহন। অনেক গাড়ি ভালো রং করে মহাসড়কে চলাচল করলেও বাস্তবে চলাচলের অযোগ্য। এসব গাড়ি বন্ধে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
তিনি বলেন, গত অর্থবছরে ফিটনেস সার্টিফিকেটসহ অন্যান্য সেবা বাবদ ৭ কোটি ৯১ লাখ ৭ হাজার ৩৪৪ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। এ ছাড়া অসংখ্য গাড়ি ইচ্ছা করেই ফিটনেস সার্টিফিকেট নবায়ন করছে না। এগুলো নবায়ন হলে কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব আয় হবে। এ জন্য যানবাহন মালিকদের বারবার তাগিদ দেয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মো. এনামুল হক বলেন, ফিটনেসহীন যানবাহনের সংখ্যা কমাতে দ্রুত উদ্যোগ নেয়া হবে। এ কাজে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নেয়া হবে। এতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে।