একদিকে মা-বাবা কাঁদছেন, অন্যদিকে ভাই-বোনেরা। প্রতিবেশীরাও ছলছল চোখে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। তবে কোনো ভাষাই যেন আজ প্রবোধ দিতে পারছে না কাউকে। সবই যেন মিছে।
হাবীব রহমান৷ সময়ের আলো পত্রিকার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর হাতিরঝিলে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তার। তার এমন মৃত্যুতে জন্মস্থান কুমিল্লায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
হাবীব কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার শশীদল ইউনিয়নের মানরা গ্রামের পেয়ার মিয়ার ছেলে। তার তিন মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে সবার বড় হাবীব।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে হাবীবের বন্ধু ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক দিদার নিজামুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে শৈশব-কৈশোর পার করেছি। মানুষের বিপদে হাবীব সবার আগে দৌড়ে যেত। কারও সঙ্গে রাগ নিয়ে তাকে কথা বলতে দেখিনি।
‘অসম্ভব মেধাবী ছিল আমার বন্ধুটি। এলাকার বাগড়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করে। চট্টগ্রাম জামেয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করে। পরে ভর্তি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে হাবীব।’
দিদার বলেন, ‘আমি বন্ধু হারিয়েছি, তার একমাত্র ছেলে বাবা হারাল। এ যে কী কষ্টের বলে প্রকাশ করতে পারব না।’
ইউপি সদস্য আশরাফ হোসেন বলেন, ‘ছোট থেকে বড় হলো। কখনও দেখিনি কারও সঙ্গে হাবীবের দ্বন্দ্ব হয়েছে। কিছুদিন আগেও সস্ত্রীক তার সঙ্গে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা হলো। কত কথা বললাম। প্রতিটি কথায় তার মুখে হাসি লেগেই ছিল। আমার এখনও বিশ্বাস হয় না হাবীব নেই। হাবীবের মতো এত অমায়িক ছেলে এই জনপদে দ্বিতীয়টি চোখে পড়েনি।’
ভাতিজাকে হারিয়ে কান্না করছিলেন হাবীবের চাচা মো. ইউনুস। বুক চাপড়িয়ে বলছিলেন, ‘আমার ছেলে। আমাকে ছোট বাবা ডাকত। আমার হাতেই বড় হয়ে উঠেছে। আমি কেমনে থাকব আমার ছেলেরে ছাড়া। আমার ছেলেটা কেমনে থাকবে কবরে।
‘আমি গাড়ি চালাতাম ঢাকায়। ২০০৬ সালে আমারে বলছিল বাবা আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হব। আমি টাকা দিলাম। আমার ছেলেটা বংশের মুখ উজ্জ্বল করে আজ কই গেল।’
ভালোবেসে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের মেয়ে হাসি আক্তার রিমিকে বিয়ে করেন হাবীব। তাদের সংসারে সৌরভ হোসেন রাজ নামে ৩১ মাস বয়সী একটি ছেলে রয়েছে।
স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে সাংবাদিক হাবীব রহমান। ছবি: সংগৃহিত
হাবীবের চাচা ইউনুস জানান, বুধবার রাত ৯টায় গ্রামের বাড়ি মানরায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
হাবীবের মৃত্যুর খবর ছড়িয়েছে ফেসবুকে। তাকে স্মরণ করে পোস্ট দিয়েছেন বন্ধু, সহপাঠী, সহকর্মীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের সাবেক উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন লিখেছেন, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠেই এমন সংবাদ… মানতেই পারছি না হাবীব। আমাদের ভাই হাবীব। সাংবাদিক হাবীব। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছোট ভাই হাবীব। গত রাতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে।’
স্মৃতিচারণ করে তিনি লেখেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যখন কাজ করেছি, যেকোনো প্রয়োজনে পাশে পেয়েছি। যে কারও বিপদে-আপদে সামনের সারিতে থাকা শাওন-হাবিব জুটির হাবিব।’
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের সহকারী প্রেস সচিব এম এম ইমরুল কায়েস লিখেছেন, ‘দৈনিক সময়ের আলোর সিনিয়র রিপোর্টার হাবীবুর রহমান হাবীবের সঙ্গে কী নিরন্তর যোগাযোগ ছিল! মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন সংবাদ সম্পর্কিত বিষয়ে প্রায়ই কথা হতো দীর্ঘক্ষণ। দিনের শুরুতে হাবীবের মতো ঘনিষ্ঠজনের মৃত্যু সংবাদে আমি শোকে মুহ্যমান।’
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের সহকারী প্রেস সচিব আশরাফ সিদ্দিকী বিটু লিখেছেন, ‘হাবীব, তোমার এমন চলে যাওয়া মেনে নেবার নয়... কেন এমন হয়!’
লেখক আহসান কবীর লিখেছেন, “কোনো ‘চলে যাওয়া’-ই মেনে নেয়া যায় না/ তবু মেনে নিতে হয়…/ হাবীবেরটাও মেনে নিতে হবে.../ মেনে নিতে হবে হাবীবের সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না! জানতে চাইবে না ভাই আপনার হাঁটার অভ্যাসটা এখনও কী বহাল আছে?’
তিনি আরও লেখেন, ‘হাবীব চলে যাওয়ার মতো বেদনা মাখানো অভ্যাস আর নেই রে...’
হাবীবের সঙ্গে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ছবি শেয়ার করে বন্ধু শাওন মাহফুজ পোস্টে লেখেন- ‘মানতেই পারছি না তুই আর নেই। আল্লাহ তোকে জান্নাতবাসী করুন। ওপারে ভালো থাকিস।’
সাংবাদিক নেতা কবির আহমেদ খান লেখেন- ‘কী করে হলো? রাত ৮টার দিকে ডিআরইউর সামনে ব্যাডমিন্টন খেলার ফাঁকে অনেক কথা হলো হাবীবের সঙ্গে। অনেক পরামর্শ করল, সেক্রেটারি নির্বাচন করবে। আমি বললাম, আমাকে আগে সভাপতি বানিয়ে নে।
‘ও বলল ঠিক আছে। রাত সাড়ে ৪টায় শরীফ উদ্দিন লিমনের ফোন, কিছুটা আঁতকে উঠি, বলে হাবীব নেই। হাতিরঝিল মোটরবাইক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। ডিএমসিতে মরদেহ। হতে পারে না হাবীব।’