সাংবাদিকদের জন্য ‘গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইন, ২০১৮’ প্রণয়নের উদ্যোগ চূড়ান্ত করেছে সরকার। জাতীয় সংসদের চলতি শীতকালীন অধিবেশনেই এটি বিল আকারে উত্থাপন করতে পারেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।
তবে প্রস্তাবিত আইনটির কিছু দিক নিয়ে অসন্তোষ জানাচ্ছেন সংবাদকর্মীরা। অন্যদিকে, সাংবাদিক নেতারা বলছেন, এ আইনের খসড়া সাংবাদিকদের দেখানো হয়নি। সরকারের একক সিদ্ধান্তেই আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
২০১৭ সালের অক্টোবরে আইনটির খসড়া প্রকাশ করে তথ্য মন্ত্রণালয়। পরের বছরের ১৫ অক্টোবর আইনের খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এরপর সেটি ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয় আইন মন্ত্রণালয়ে। এর তিন বছরেরও বেশি সময় পর আইনটি পাশের জন্য সংসদে তোলা হচ্ছে।
আইনটিতে সাংবাদিকদের বেতন, ভাতা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, ছুটিসহ বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তথ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আইনটি পাস হলে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, রেডিও এবং অনলাইন মিডিয়ায় যারা কাজ করেন তাদের সুরক্ষা দেয়া সম্ভব হবে।’
খসড়া অনুযায়ী, আইনটি পাস হলে সংবাদকর্মীরা আর শ্রম আইনের অধীনে থাকবেন না। আইনি কাঠামোতে সাংবাদিকরা ‘গণমাধ্যমকর্মী’ হিসেবে পরিচিত হবেন।
২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর মন্ত্রিসভা বৈঠক শেষে আইনটি নিয়ে ব্রিফ করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম।
সেদিন তিনি খসড়া আইনের বিভিন্ন দিক তুলে বলেন, ‘গণমাধ্যমকর্মীর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, গণমাধ্যমে কর্মরত পূর্ণকালীন সাংবাদিক, কলাকুশলী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, কর্মচারী বা নিবন্ধিত সংবাদপত্রের মালিকাধীন ছাপাখানা এবং বিভিন্ন বিভাগে নিয়োজিতরা হলেন গণমাধ্যমকর্মী। সম্প্রচারকর্মী হলেন, সম্প্রচার কাজে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত গণমাধ্যমের কর্মী।’
তিনি বলেন, ‘প্রযোজক, পাণ্ডুলিপি লেখক, শিল্পী, ডিজাইনার, কার্টুনিস্ট, ক্যামেরাম্যান, অডিও ও ভিডিও এডিটর, চিত্র সম্পাদক, শব্দ ধারণকারী, ক্যামেরা সহকারী, গ্রাফিক্স ডিজাইনারসহ পেশাজীবীরা যারা এই কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের কলাকুশলী বলা হবে।’
তবে ‘কলাকুশলী’র সংজ্ঞা নিয়ে আপত্তি রয়েছে সংবাদ মাধ্যমে কর্মরতদের। ক্যামেরাপারসনদের সাংবাদিক না বলে ‘কলাকুশলী’ বলার প্রতিবাদে তথ্য ও আইন মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দিয়েছে টিভি ক্যামেরা জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (টিসিএ)।
সংগঠনটির সভাপতি শেখ মাহবুব আলম নিউজবাংলাকে বলেন, “আমাদের দাবি, আমাদের ‘চিত্রসাংবাদিক’ হিসেবে মূল্যায়ন করা হোক। সেজন্য আমরা চিঠি দিয়েছি।”
সংসদে খসড়া আইনটি বিল আকারে উত্থাপনের আগেই এটি সংশোধনের দাবি জানান টিসিএ সভাপতি মাহবুব।
নিউজ টোয়েন্টিফোর টেলিভিশনের ক্যামেরাপারসন ও ভিডিও জার্নালিস্টদের সংগঠন টিসিএর সাবেক নেতা আহসান সুমন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সাংবাদিকতায় রিপোর্টারদের পাশাপাশি চিত্রগ্রাহকদেরও সাংবাদিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। কিন্তু খসড়া আইনে কলাকুশলী বলে আমাদের বিচ্ছিন্ন করাটা দুঃখজনক।’
ভিডিও চিত্র সম্পাদনকারীদের সাংবাদিক না বলে কলাকুশলী বলায় ক্ষোভ জানান ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের সিনিয়র ভিডিও এডিটর রিফাত আনোয়ার লোপা।
তিনি বলেন, ‘টেলিভিশন সাংবাদিকতায় ভিডিও এডিটিং ছাড়া রিপোর্ট তৈরি করা সম্ভব নয়। একটি রিপোর্টে সিকোয়েন্স অনুযায়ী কোন ছবিটির পর কোন ছবি বসবে সেই সিদ্ধান্ত বেশিরভাগ সময় ভিডিও এডিটরদের নিতে হয়। ফলে এডিটরদের সেখানে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।’
টেলিভিশন সাংবাদিকতা শুধু তথ্য ও ছবি যোগাড়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সেখানে চিত্র সম্পাদনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তাই ভিডিও এডিটরদের অবশ্যই সাংবাদিক বলা উচিত।’
সাংবাদিক সংগঠনের নেতাদের অভিযোগ, আইনটি সম্পর্কে তাদের ভালোভাবে জানানো হয়নি, মতামতও নেয়া হয়নি।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গণমাধ্যম আইনের যে খসড়া করা হয়েছে আমরা সেটা সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত নই।
‘সাংবাদিক সমাজে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার সমুন্নত রাখার যে দাবি আমাদের রয়েছে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সাংবাদিকদের পেনশনের আওতায় আনা জরুরি।’
সাংবাদিকদের জন্য বছরে দুটি গ্র্যাচুইটির বদলে এখন চারটি করার দাবি উঠেছে বলেও জানান তিনি। সাজ্জাদ আলম খান তপু বলেন, ‘প্রতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে প্রত্যেক সংবাদ কর্মী যেন বেতন পান সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
আইনটি প্রণয়নের আগে সাংবাদিকদের সব ধরনের ন্যায্য দাবি বিবেচনায় নেয়ার আহ্বান জানান এই সাংবাদিক নেতা।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি ও সাংবাদিক নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য আইন করা হচ্ছে, কিন্তু তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি।’
আইনটি সংসদে পাসের আগে সংসদীয় কমিটি যেন অংশীজনের বিভিন্ন মতামত বিবেচনা নেয় সেই আহ্বানও জানান মনজুরুল আহসান বুলবুল।
গণমাধ্যম আইনে সংবাদকর্মীদের অধিকার নিশ্চিতের ওপর জোর দিয়েছেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান।
তিনি বলেন, ‘ইতোপূর্বে আমাদের অভিজ্ঞতা খুব খারাপ। যেমন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। সেখানেও গণমাধ্যমে যারা নেতৃত্বে আছেন, তাদের মতামত নেয়া হয়েছিল, কিন্তু সে মতামতগুলো রাখা হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘বিশেষ কোনো দলের সমর্থক গণমাধ্যম নেতাদের মতামত নিলে হবে না। সব পক্ষের লোকজনের মতামত নিতে হবে।’
সংবাদমাধ্যমের সবার সঙ্গে আলোচনা করে আইন করার পক্ষে মত দিচ্ছেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম হাসিব।
তিনি বলেন, ‘যাদের জন্য আইনটা করা তাদের নিয়ে তাদের মতামতের প্রতিফলন ঘটিয়ে এটা করতে হবে। তা না হলে আইনটা সফল হবে না।’
অর্থনৈতিক সংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সভাপতি শারমীন রিনভী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গণমাধ্যম আইন নিয়ে অনেক দিন ধরে কথা হচ্ছে। কিন্তু আইনটি পুরোপুরি পাস করার আগে সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। কোনো ধরনের আলোচনা না করে আইনটি সংসদে পাস হলে এটা সাংবাদিকদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।’
সংসদে কবে উঠছে
জাতীয় সংসদের শীতকালিন অধিবেশন শুরু হয়েছে রোববার। দুই কর্মদিবসের পর রোববার পর্যন্ত অধিবেশন মুলতবি করেছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
সংসদ সচিবালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেন, বুধবার পর্যন্ত ‘গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) আইন, ২০১৮’-এর খসড়া বিল আকারে সংসদ সচিবালয়ের আইন শাখায় জমা হয়নি।
তবে চলমান অধিবেশনে এটি বিল আকারে উত্থাপনের সম্ভাবনা এখনও রয়েছে। আর সেটি হলে যে কোনো সময় এটি আইন শাখায় জমা পড়তে পারে বলেও জানান সংসদ সচিবালয়ের ওই কর্মকর্তা।
যা থাকছে গণমাধ্যমকর্মী আইনে
চাকরির এক বছর পর প্রভিডেন্ট ফান্ড
আইনের খসড়া অনুযায়ী, সংবাদমাধ্যমকর্মীদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড গঠন করতে হবে। বর্তমানে নিয়োগের দুই বছর পর ভবিষ্যৎ তহবিলে মাসিক চাঁদা দেয়ার সুযোগ থাকলেও, নতুন আইনে তা এক বছর পরেই করার বিধান রাখা হচ্ছে।
সর্বনিম্ন ৮ ও সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ অর্থ এই তহবিলে জমা রাখা যাবে। আগে ৭ শতাংশ অর্থ জমা রাখা যেত। মালিককে সমহারে টাকা রাখতে হবে।
সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা ৩৬
নতুন আইনে সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা ৪৮ থেকে কমিয়ে ৩৬ ঘণ্টা করা হচ্ছে। এর চেয়ে বেশি কাজ করালে ওভারটাইম পাবেন সাংবাদিকরা।
ছুটিতে যত সুবিধা
১০ দিনের নৈমিত্তিক ছুটি বাড়িয়ে ১৫ দিন করা হচ্ছে। অর্জিত ছুটি ৬০ দিনের বদলে ১০০ দিন। ১১ দিনে একদিন করে জমা হবে।
প্রত্যেক সংবাদকর্মী চাকরির ১৮ ভাগের এক ভাগ সময় অসুস্থতাজনিত ছুটি পাবেন। এ ক্ষেত্রে নিবন্ধিত রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্র থাকতে হবে।
সংবাদকর্মীরা এককালীন বা একাধিকবার সর্বোচ্চ ১০ দিন উৎসব ছুটি ভোগ করতে পারবেন। নারীরা সরকারি বিধি অনুযায়ী অর্থাৎ ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি পাবেন। বর্তমানে আট সপ্তাহ মাতৃত্বকালীন ছুটি পান নারী কর্মীরা।
খসড়া আইন অনুযায়ী সংবাদকর্মীরা তিন বছর পরপর পূর্ণ বেতনসহ শ্রান্তি বিনোদন ছুটি পাবেন। তারা বিধিমালা অনুযায়ী স্বাস্থ্য বীমা সুবিধা পাবেন।
পাওনা আদায়ে করা যাবে মামলা
সংবাদ প্রতিষ্ঠান থেকে বকেয়া পাওনা আদায়ে কর্মী বা তার লিখিত ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি, মৃত কর্মীর ক্ষেত্রে তার পরিবারের কোনো সদস্য যথোপযুক্ত আদালতে মামলা করতে পারবেন।
খসড়ায় আইনে সংবাদকর্মীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। তবে এটি বিধি দিয়ে নির্ধারণ করা হবে বলে জানিয়েছিলেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম।
আইন ভাঙলে জরিমানা পাঁচ লাখ টাকা
এই আইনের কোনো ধারা বা আইনের অধীনে প্রণীত বিধি লঙ্ঘন করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এর জন্য প্রতিষ্ঠান মালিককে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা ও সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। জরিমানা আদায় না হলে জেল দিতে পারবে আদালত।
এ ছাড়া আইন লঙ্ঘনকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়াসহ যে কোনো পর্যায়ে সরকারের দেয়া যে কোনো সুযোগ-সুবিধা স্থগিত বা বন্ধ করে দিতে পারবে সরকার।
চাকরিবিধি পরিদর্শনে কমিটি
আইনে পরিদর্শন কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। পরিদর্শন কমিটির সদস্যরা পরিদর্শক হিসেবে গণ্য হবেন। পরিদর্শন কমিটির অনুমোদন সাপেক্ষে, প্রত্যেক সংবাদ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব চাকরিবিধি থাকবে, যা এই আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সংবাদ প্রতিষ্ঠানে নারীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে প্রচলতি আইন অনুসরণ করে নীতিমালা প্রণয়ন করে অভিযোগ নিরসন পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে।
সংবাদকর্মীদের জন্য প্রজ্ঞাপন দিয়ে সরকার ওয়েজবোর্ড গঠন করবে। ওয়েজবোর্ডের সিদ্ধান্ত সব সংবাদমাধ্যম মালিককে পালন করতে হবে।