ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সাইদা খালেক খুন হওয়ার পর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আবাসন প্রকল্প’র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রায় ৮৫ একর জমির ওই আবাসন প্রকল্পের নিরাপত্তায় কোনো জোরদার ব্যবস্থা নেই। প্রকল্প এলাকার বিভিন্ন জায়গায় প্রাচীর ভাঙ্গা। পুরো এলাকায় নেই কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা ও সড়ক বাতি। প্রকল্পের নিরাপত্তায় প্রতি শিফটে মাত্র তিনজন নিরাপত্তাকর্মী নিয়োজিত। মূল ফটক দিয়ে কেউ ভেতরে ঢোকা বা বের হওয়ার সময় রেজিষ্ট্রার খাতায়ও তা লিপিবদ্ধ করা হয় না।
অধ্যাপক সাইদা খালেক হত্যার পর তার ছেলে ইফখার বিন জহির মায়ের খুনের জন্য প্রকল্প এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, ‘এতো বড় আয়তনের প্রকল্প অথচ সেই অনুযায়ী কোনো নিরাপত্তাকর্মী নেই। প্রকল্পের দায়িত্বশীলদের গাফিলতি রয়েছে। তাদের অব্যবস্থাপনার কারণেই মাকে হারালাম।’
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ১৯৯০ সালে কাশিমপুরের পানিশাইল এলাকায় শুরু হয় শিক্ষকদের এই বিশাল আবাসন প্রকল্প। ৮৫ একর এলাকার বেশিরভাগ স্থানেই ঝোপঝাড় ও নির্জন। বর্তমানে প্রকল্পটিতে ৬২৮টি প্লট ও ৬৪০ জন সদস্য রয়েছেন।
প্রায় ৩২ বছর আগে আবাসন প্রকল্পটি গড়ে উঠলেও সেখানে বাড়ি নির্মাণ করে বসতি গড়েছেন মাত্র তিন-চারজন শিক্ষক ও তাদের পরিবার। তিন মাস আগে ২৮০ নম্বর প্লটে বাড়ি নির্মাণ শুরু করেন অধ্যাপক সাইদা খালেক। এজন্য প্রকল্প এলাকার পাশেই একটি ভাড়া বাড়িতে ওঠেন তিনি। সেখানে থেকেই নিয়মিত নির্মাণাধীন বাড়ির কাজ তদারকি করতেন।
সরেজমিনে প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আবাসন প্রকল্প’র মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই দেখা গেল একজন নিরাপত্তাকর্মী। তবে কোথায় এবং কার কাছে যাচ্ছেন সে বিষয়ে তিনি কিছুই জিজ্ঞেস করেননি।
উঁচু গাছপালা ঘেরা প্রকল্পটিতে দিনের বেলাতেই ভুতুড়ে পরিবেশ। হেঁটে ১০ মিনিট যাওয়ার পর চোখে পড়ল অধ্যাপক সাইদা খালেকের নির্মাণাধীন একতলা বাড়িটি। এর পাশেই আবাসন প্রকল্পের গেষ্ট হাউজ। তবে সেখানেও কোন মানুষজনের দেখা মিললো না।
আবাসন প্রকল্পের ভেতর থেকে শাক-সবজি ও কলা সংগ্রহ করে পাশের বাজারে বিক্রি করেন মো. শরিফ মিয়া। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘প্রায় তিন থেকে চারমাস আগে ২৮০ নম্বর প্লটে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেন অধ্যাপক সাইদা খালেক। সেই থেকে প্রতিদিনই আসলে ম্যাডামকে দেখতাম। তিন-চারজন রাজমিস্ত্রি কাজ করতেন, তাদের সঙ্গে ম্যাডামকে কথাবার্তা বলতে দেখতাম।’
শরিফ মিয়া বলেন, ‘হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার আনোয়ারুলকে প্রতিদিনই কাজ করতে দেখতাম। ঘটনার দিনও তাকে দেখেছি। ম্যাডাম প্রতিদিনই একটি পোষা কুকুর নিয়ে আসতেন। তবে ঘটনার দিন কুকুরটা নিয়ে আসেননি।’
প্রকল্পের বাসিন্দা আশিকুর রহমান বলেন, ‘ম্যাডাম প্রতিদিনই আসা-যাওয়ার জন্য পশ্চিম দিকের রাস্তা ব্যবহার করতেন। উনার মরদেহ পাওয়া গেছে পূর্ব দিকের রাস্তার পাশে। সেখানে তিনি কিভাবে গেলেন এবং কেন গেলেন ঠিক বুঝতে পারছিনা।’
আশিকুর রহমান আরও বলেন, ‘ম্যাডাম নিখোঁজের খবর পাওয়ার পর পুলিশ-ডিবি, ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল, প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আমরা সবাই পুরো এলাকায় খোঁজাখুঁজি করেছি। অথচ যে রাস্তা দিয়ে সবাই যাতায়ত করেছে সেই রাস্তার পাশেই পড়ে ছিলো তার মরদেহ। তিনদিন ধরে মরদেহটি সেখানে পড়ে ছিল, অথচ কারও চোখেই পড়েনি।’
অধ্যাপক সাইদা খালেক নিখোঁজের ঘটনার দিন প্রকল্পের মূল ফটকে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন সিকিউরিটি ইনচার্জ জয়নাল আবেদিন। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘অধ্যাপক সাইদা ম্যাডাম কখনও মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেন না। তিনি পশ্চিম পাশের এক নম্বার গেইট ব্যবহার করতেন। ওই গেট সবসময় বন্ধ থাকতো। শুধুমাত্র ম্যাডামের কাছে একটি চাবি ছিলো, যা দিয়ে তিনি গেইট খুলে আসা-যাওয়া করতেন।’
আবাসন প্রকল্প এলাকায় প্রতিদিন কারা আসছেন এবং বের হচ্ছেন সে তথ্য চাইলে নিরাপত্তাকর্মী জয়নাল একটি রেজিষ্ট্রার খাতা খুলে দেখান। কিন্তু ওই খাতায় ১১, ১২ ও ১৩ জানুয়ারির কোনো তথ্যই লেখা নেই।
ঘটনার দিন রাজমিস্ত্রি আনোয়ারুল কোন গেট দিয়ে বের হয়েছেন, জানতে চাইলে জয়নাল বলেন, ‘সকালে আনোয়ারুল কাজে আসেন। তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। দুপুর দুইটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত আমি মূল ফটকের দায়িত্বে ছিলাম। কিন্তু ওই সময়ে আনোয়ারুলকে বের হতে দেখিনি।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আবাসন প্রকল্পের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. শওকাত আলী বলেন, ‘অধ্যাপক সাইদা খালেকের অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনাটি আমাদেরকে অনেক শিক্ষা দিয়েছে। আমাদের নিরাপত্তাব্যবস্থায় ঘাটতি ছিল না তা না। আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না।’
তিনি বলেন, ‘প্রকল্প এলাকায় মাত্র চারটি পরিবার থাকে। তাদের বাড়িতেই শুধু বিদ্যুতের ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা শিগগিরই পুরো প্রকল্প এলাকায় সড়ক বাতি ও সিসি ক্যামেরা স্থাপন করব। এছাড়াও নিরাপত্তা বেষ্টনিগুলো সংস্কার করা হবে। এজন্য প্রকল্পের প্রত্যেক সদস্যকে আগামী ১১ ফেব্রুয়ারি ডাকা হয়েছে।’
অধ্যাপক সাইদা খালেকের ভাড়া বাড়ির মালিক মোশারফ হোসেন মৃধা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘৮-৯ মাস আগে আমার বাড়ি ভাড়া নেন তারা। ম্যাডাম ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন। মাঝেমধ্যে তার ছেলে ও ছেলের স্ত্রী আসতেন।’
উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবাসন প্রকল্পে চলছিল অধ্যাপক সাইদা খালেকের বাড়ি নির্মাণের কাজ। প্রকল্প এলাকার পাশেই একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। গত ১১ জানুয়ারি নিখোঁজ হন এই অধ্যাপক। এর দুদিন পর ১৩ জানুয়ারি তার মেয়ে সাদিয়া কাশিমপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তদন্তে নামে পুলিশ।
১৪ জানুয়ারি গাইবান্ধা থেকে ওই প্রকল্পের রাজমিস্ত্রি আনোয়ারুল নামে আটক করে পুলিশ। আটকের পর তার দেয়া তথ্যে কাশিমপুর এলাকার শিক্ষক আবাসন প্রকল্প থেকে অধ্যাপক সাইদার মরদেহ উদ্ধার হয়।
আনোয়ারুল পুলিশের কাছে স্বীকার করেন,দৈনিক মজুরি দেয়ার সময় সাইদার কাছে অনেক টাকা ছিল। তা দেখে লোভ সামলাতে পারেননি তিনি। একপর্যায়ে নির্মাণাধীন বাড়ি থেকে ৪০০ গজ দূরে অধ্যাপকের ওড়না দিয়েই তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। পরে মরদেহ ঝোপে ফেলে পালিয়ে যান তিনি।