শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ ও মিছিল হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল করেছে প্রগতিশীল ছাত্র জোট ও ছাত্র অধিকার পরিষদ।
রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ করেন প্রগতিশীল ছাত্র জোট আর সাড়ে ৭টায় ক্যাম্পাসে মশাল মিছিল করেন ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাকর্মীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র থেকে প্রগতিশীল ছাত্র জোটের বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়।
এ সময় তারা ‘পুলিশের হামলা, রুখে দাও বাংলা’, ‘লাঠি, পুলিশ, টিয়ারগ্যাস, জবাব দিবে বাংলাদেশ’, ‘সাস্টে হামলা কেন, শেখ হাসিনা জবাব চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
বিক্ষোভ শেষে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দীন প্রিন্স বলেন, ‘গতকাল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করেছে।
আর আজ বিকেলে ক্যাম্পাসের মধ্যে পুলিশ ঢুকে নির্মমভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে। রাবার বুলেট নিক্ষেপ করেছে।
‘প্রশাসনের এত কিসের ভয় যে একটি হলের নারী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সহ্য করতে পারছে না। এই সরকারের পতনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ওপর দমন-পীড়নের শেষ হবে।’
প্রিন্স বলেন, ‘সরকারের কানে আমরা পৌঁছে দিতে চাই, যতই লাফালাফি করেন বা উন্মত্ত হয়ে শিক্ষার্থীদের দমন-পীড়ন করেন না কেন, আপনাদের শেষ রক্ষা হবে না। অবিলম্বে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে দমন-পীড়নের পথ পরিহার করুন। অন্যথায় বাংলার ছাত্র সমাজ আপনাদের গদি থেকে উৎখাত করে ছাড়বে।’
এ সময় অন্যদের মধ্যে ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা, ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দীপক শীল, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক দিলীপ রায়, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সহসভাপতি সাইদুল হক নিশান, ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি অনিক রায় প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ছাত্র অধিকার পরিষদের মশাল মিছিল
শাবিপ্রবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ ও তাদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মশাল মিছিল করেছে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ।
মিছিলের আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে আয়োজিত এক সমাবেশে ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, ছাত্রদের গায়ে টিয়ারশেল মারলে ফল খুব ভালো হয় না। কোনো শিক্ষার্থীর গায়ে গুলির ছড়া লাগলে তার ফলাফল আপনাদের গদি পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিতে পারে। ছাত্রদের এই আন্দোলন জোর করে বন্ধ করার চেষ্টা করবেন না।
শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার কারণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে দুঃখ প্রকাশ করার আহ্বান জানান বিন ইয়ামিন। তিনি বলেন, আপনি যদি দুঃখ প্রকাশ না করেন, তাহলে শিক্ষার্থীরা আপনার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করবে।
বিন ইয়ামিন বলেন, আমরা বিশ্বাস করি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক হবে আন্তরিক। কিন্তু সেই শিক্ষক নিজের আত্মরক্ষার জন্য ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। ধিক্কার জানায় এ রকম শিক্ষকের প্রতি। আমরা এই উপাচার্যের পদত্যাগ চাই।
সমাবেশ শেষে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসে মশাল মিছিল বের করেন। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘আমার বোন আহত কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘ভাইয়ের বুকে গুলি কেন, প্রশাসন জবাব দে’, ‘শাবিপ্রবিতে হামলা কেন, প্রশাসন জবাব চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
হামলার প্রতিবাদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার ঘটনায় বিক্ষোভ মিছিল করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
রোববার রাত সাড়ে ৮টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্বর থেকে একটি মিছিল শুরু হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার সামনে এসে শেষ হয়। পরে সেখানে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ হয়।
সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক সংগঠন জুডোর সহসভাপতি তাপসী দে প্রাপ্তি বলেন, ‘এটি এখন আর শাহজালালের বিষয় নয়, এটি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়। আমার, প্রত্যেকের যার যার পক্ষ থেকে এটির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।’
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট জাবি শাখার আহ্বায়ক শোভন রহমান বলেন, ‘একসময় প্রক্টররা বলতেন ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর আগে আমাদের ওপর গুলি চালাতে হবে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমাদের অর্জন, ভিসিরা পুলিশ ডাকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করার জন্য। শাহজালালের শিক্ষার্থীদের ওপর ভিসির মদদে পুলিশ হামলা চালিয়েছে। এই হামলা শুধু শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা নয়, এটি সারা দেশের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা। আমরা এ হামলার তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানাই।’
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট জাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদের সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) সংসদের দপ্তর সম্পাদক ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলি। এ সময় প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।
কী হয়েছিল শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে
প্রাধ্যক্ষ জাফরিনের পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা হলের ছাত্রীরা বৃহস্পতিবার রাত থেকে বিক্ষোভ শুরু করেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে তারা সরে যান। দাবি পূরণ না হওয়ায় শনিবার সন্ধ্যায় ফের বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়ক আটকে তারা বিক্ষোভ শুরু করেন।
মধ্যরাতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়ে সরে গেলেও রোববার সকাল থেকে ফের শুরু হয় তাদের বিক্ষোভ। তাতে যোগ দেন সহপাঠীরাও।
বেলা ৩টার দিকে নিজ কার্যালয় থেকে বের হয়ে বাসভবনের দিকে যাওয়ার পথে উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে যান আন্দোলনকারী ছাত্রীরা। এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে উপাচার্যকে ঘেরাও করে স্লোগান দিতে থাকেন তারা। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়ায় আইআইসিটি ভবনে গিয়ে অবস্থান নেন উপাচার্য ফরিদ।
বিকেল ৪টার দিকে সেখানে পুলিশ সদস্যরা অবস্থান নিলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তারা ‘ক্যাম্পাসে পুলিশ কেন’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। কোষাধ্যক্ষ আনোয়ারুল ইসলাম ও অন্য শিক্ষকরা গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করেন।
উত্তেজনা বাড়তে থাকলে পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। শিক্ষার্থীরাও ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। এরপর শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া।
শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে কয়েকটি রাবার বুলেট ছোড়া হয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ উপদেষ্টা অধ্যাপক জহির উদ্দিন আহমেদ গুলিবিদ্ধ হন।
এর মধ্যেই বিক্ষোভকারীদের আইআইসিটি ভবন থেকে হটিয়ে উপাচার্যকে বের করে তার বাসভবনে নিয়ে যায় পুলিশ।
মহানগর পুলিশের উপকমিশনার আজবাহার আলী শেখ জানান, পুলিশের গুলিতে অধ্যাপক জহির গুলিবিদ্ধ হননি। ওই গুলি কারা ছুড়েছে তা তিনি জানেন না। তাকে মাউন্ড এডোরা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় এক নারী কনস্টেবলও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ইটের আঘাতে তিনিও আহত হয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আলমগীর কবীর জানান, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় শিক্ষক, পুলিশ ও শিক্ষার্থীসহ অন্তত অর্ধশত আহত হয়েছেন। তাদের সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রক্টর আরও জানান, গুলিবিদ্ধ অধ্যাপক জহিরকে মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি শঙ্কামুক্ত।
এদিকে, তিন দফা দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও এর জেরে পুলিশ-শিক্ষার্থী সংঘর্ষের পর রোববার সন্ধ্যায় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের সোমবার দুপুর ১২টার মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
জরুরি সিন্ডিকেট সভা শেষে রোববার রাতে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ এ কথা জানিয়েছেন।