নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে জয়-পরাজয়ের নানা বিশ্লেষণ থাকলেও আলোচিত দুই মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তৈমূর আলম খন্দকার কেউই ইশতেহার নিয়ে আসেননি সাধারণ মানুষের কাছে। প্রচারণায় বেশির ভাগেই ছিল দলীয় রাজনৈতিক নিয়ে উত্তাপ, কাদা ছোড়াছুড়ি।
প্রধান দুই প্রার্থী নির্বাচনি প্রচারে গিয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ইশতেহার আকারে নগরবাসীর কাছে তুলে ধরেননি কেউই। কেন ইশতেহার দেননি তার কারণও তারা জানাননি।
এমন বাস্তবতায় রোববার হতে যাচ্ছে ভোট। এর মধ্য দিয়ে আগামী পাঁচ বছরের জন্য অভিভাবক পাবে নারায়ণগঞ্জবাসী। মেয়রের চেয়ারে আইভীই থাকবেন, না কি বসবে নতুন মুখ, তা জানতে খুব বেশি অপেক্ষা নেই।
নির্বাচনি প্রচারণার সময় উত্তাপ ছড়ানো নারায়ণগঞ্জে ভোটের আগের দিন যেন ভর করেছে রাজ্যের নীরবতা। নির্বাচন নিয়ে নেই কোনো শোরগোল। উধাও চায়ের দোকানগুলোর গত কয়েক দিনের ভিড়।
তবে ভোটারদের মধ্যে আক্ষেপ, মেয়র নির্বাচিত হলে আইভী বা তৈমূর নগরীর উন্নয়নে কী করবেন, সে ব্যাপারে তারা কোনো ইশতেহার দেননি।
শীতলক্ষ্যা নদী দ্বিখণ্ডিত করেছে নারায়ণগঞ্জ শহরকে। নদীর এ পার মূল শহর, অন্য পাড়ে বন্দর। রাত গভীর হলেই একেবারে বিচ্ছিন্ন জনপদে রূপ নেয় সিটি করপোরেশনভুক্ত বন্দর অংশটি। তাই নারায়ণগঞ্জবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি, যিনিই মেয়র হিসেবে আসুন, নগরীর দুই অংশ যেন একটি সেতুতে এক বানানোর উদ্যোগ নেন।
এবার নির্বাচনে কদম রসুল সেতু নির্মাণ বড় প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এবার নির্বাচিত হলে সেতুটি নির্মাণে জোর নজর দেবেন বলে জানালেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী।
নিউজবাংলার সঙ্গে একান্তে আলাপে নৌকা প্রতীকের এই প্রার্থীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, মেয়র নির্বাচিত হলে কোন কাজটি তিনি আগে করবেন।
এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট জবাব না দিলেও আইভী বলেন, ‘আমার কাজগুলো চলমান। স্পেসিফিক একটা কথা বলতে পারব না। সব কাজ আমাকে দেখতে হবে ভালো করে।’
আইভী আলাদা করে বললেন মূল শহরের সঙ্গে বন্দরকে সংযুক্ত করার পরিকল্পনাটি। তিনি বলেন, ‘তবে দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে চেষ্টা করব কদম রসুল ব্রিজটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করানোর প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে। কারণ এটা অলরেডি অনেক কাজ হয়ে গিয়েছে। অল্প একটু বাকি আছে। ওই কাজটিকে প্রাধান্য নিয়ে অন্যান্য কাজগুলো করব।’
মেয়র নির্বাচিত হলে নারায়ণঞ্জ নগরবাসীর জন্য কী করার পরিকল্পনা আছে, এ বিষয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারকেও প্রশ্ন রাখে নিউজবাংলা।
তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশনে ঠিকাদারদের যে সিন্ডিকেট আছে, যারা সিটি করপোরেশন চালাচ্ছে এবং যারা মেয়রের (আইভী) নির্বাচনি কার্যক্রম পরিচালনা করছে, ওই সিন্ডিকেট আমি ভেঙে দেব। তাদের সিটি করপোরেশন থেকে আমি বের করে দেব।’
সিটি করপোরেশনকে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে রূপ দেয়ার অঙ্গীকার করে তৈমূর বলেন, ‘মানুষ চায় একটা অসাম্প্রদায়িক নগরী। যেটা আমাদের পক্ষে সম্ভব। মানুষ চায় একটি গণমুখী সিটি করপোরেশন। হোল্ডিং ট্যাক্স সহনীয় পর্যায়ের সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, এটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান না।’
তৈমূরের এমন অভিযোগ স্রেফ ‘নির্বাচনি প্রচার’ বলেই উড়িয়ে দিয়েছেন আইভী। তিনি বলেন, ‘সিন্ডিকেটের কোনো সত্যতা নেই। কারণ, এখন ই-টেন্ডার হয়। ই-টেন্ডারে সিন্ডিকেট গড়ার কোনো উপায় নেই। এই অভিযোগ আমি ২০১১ থেকে শুনে আসছি। আমার কাকা (তৈমূর) কেন এত দিন এই অভিযোগটি আনলেন না, উনি তো একটা দায়িত্বশীল পদে ছিলেন।’
সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়াকে নিজের প্রথম কাজ হবে বলে তৈমূর নিউজবাংলাকে জানালেও গণসংযোগে অংশ নিয়ে প্রথম কাজ হিসেবে উল্লেখ করেন হোল্ডিং ট্যাক্স কমানোকে।
গণমাধ্যমকর্মীদের তিনি বলেন, ‘নাগরিকদের নিরাপত্তা নাগরিকদের সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েই আমি নির্বাচনে নেমেছি। আমি যদি নির্বাচিত হই, তাহলে আমার প্রথম কাজ হবে অযাচিতভাবে যে হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধি করা হয়েছে, সিটি করপোরেশনের দ্বারা যে জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি করা হয়েছে, সেগুলো কমিয়ে আনা হবে। হোল্ডিং ট্যাক্স কমানো হবে। পানির ট্যাক্স কমানো হবে। প্রয়োজনবোধে পানির ট্যাক্স নেয়া হবে না। ট্রেড লাইসেন্স পূর্বের জায়গা নিয়ে যাওয়া হবে।’
সিটি করপোরেশনে জন হয়রানির বদলে সেবা বাড়ানোরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তৈমূর। বলেন, ‘খেটে খাওয়া মানুষের পেটে লাথি দেয়া যাবে না। তাদের আগে পুনর্বাসন করতে হবে। তারপর তাদের বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। পুনর্বাসন ছাড়া কাউকে উচ্ছেদ করা যাবে না।’
পাশাপাশি জলবদ্ধতা নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান তৈমূর।
অন্যদিকে নির্বাচনি প্রচারে অংশ নিয়ে আইভী বলেছেন, তার নেয়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পগুলো চলমান রাখার পাশাপাশি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুপেয় পানি নিশ্চিত করতে চান নগরবাসীর জন্য।
তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যত পরিকল্পনা যদি বলেন, আমি আমার কাজগুলোকে কন্টিনিউ রাখব। বিশেষ করে প্রাধান্য দেব, আমাদের খাল, পুকুরগুলোয়, খেলার মাঠের দিকে। সিদ্ধিরগঞ্জে ওয়াসার পানি নেই। এখানে বাড়ি বাড়ি ডিপ টিউবওয়েল বসানো। ঢাকা ওয়াসা যখন ছিল, তখন এই সমস্ত এলাকাগুলোতে পানি দেয়া হয়নি।
‘ঢাকা ওয়াসা থেকে আমি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে ওয়াসা নিয়ে নিয়েছি। আমি সুপেয় পানিটা দেয়ার বেশি চেষ্টা করব। আমাদের অলরেডি একটা প্রজেক্ট শুরু হয়েছে এডিবির। ২৮ শ কোটি অলরেডি এডিবি আমাকে দিয়েছে, আমি সেটা দিয়ে আমার যে অঞ্চলগুলোতে পানির লাইন নেই সেখানে লাইনগুলো দেয়ার চেষ্টা করব।’
নির্বাচনের আগে জনগণের কাছে তুলে ধরা প্রতিশ্রুতি, লিখিত ও মুদ্রিত আকারে উপস্থাপন হয় নির্বাচনি ইশতেহারে। এটা অনেকটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ভোটাররা কোন প্রার্থীকে কী প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ভোট দেবেন সে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হয়ে থাকে ইশতেহার। নাগরিক সমাজের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও প্রার্থীদের প্রতি নির্বাচনি ইশতেহার প্রকাশের আহ্বান থাকে।
ইশতেহার দেয়া বাধ্যতামূলক না হলেও না দেয়াটা দুঃখজনক বলে মনে করছেন নারায়ণগঞ্জের নির্বাচন বিশ্লেষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল করিম দীপু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ইশতেহার হচ্ছে আমাদের দেশের নির্বাচনের একটি সংস্কৃতি। যুগের পর যুগ ধরে ভোটাররা এই সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত। প্রার্থীরা এই নির্বাচনে রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে বেশি মাতামাতি করেছেন। সেজন্য হয়তো ইশতেহার দেয়ার কথা ভুলে গেছেন।’
জাহিদুল বলেন, ‘তরুণ ভোটারদের জন্য এটি কোনো ভালো দৃষ্টান্ত হলো না। কারণ আমরা তাদের ওই সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করাতে পারলাম না।’
নারায়ণগঞ্জে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ধীমান সাহা জুয়েল বলেন, ‘ইশতেহার বাধ্যতামূলক নয়। তবে এটি তো আমাদের নির্বাচনি সংস্কৃতি।’
সব প্রার্থীর ইশতেহার দেয়া উচিত ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার হাতে একটি কাগজ থাকলে আমার মেয়র আমার জন্য কী বলছেন, এবং কী করছেন সেটা মিলিয়ে নিতে সুবিধা হতো।’