বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মজুরি বৃদ্ধির সমানতালে ছুটছে মূল্যস্ফীতি

  •    
  • ১৫ জানুয়ারি, ২০২২ ১০:৩৩

ডিসেম্বর শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। আর ওই মাসে মজুরি বেড়েছে ৬ দশমিক ১১ শতাংশ। অর্থাৎ এখন জাতীয় পর্যায়ে মজুরি বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির হার প্রায় সমান হয়ে গেছে।

মোহাম্মদ সেলিম। রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় এভারগ্রিন নামের একটি সেলুনে নরসুন্দরের কাজ করেন পাঁচ বছর ধরে। করোনার আগে প্রতিদিনের মজুরি এবং বকশিশ মিলিয়ে মাসে ২৩ থেকে ২৪ হাজার টাকা উপার্জন করতেন। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে মোটামুটি চলে যেত। সামান্য কিছু হলেও সঞ্চয় করতেন। করোনার প্রকোপ কমলেও এখন আগের মতো আর কাজ নেই, উপার্জন নেমে এসেছে অর্ধেকে।

৩০ বছর বয়সী সেলিম তার কষ্টের কথা নিউজবাংলাকে বললেন এভাবে, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে স্যার এখন। করোনার ভয়ে মানুষ আর আগের মতো চুল কাটাতে, শেভ করতে, ফেসিয়াল করতে আসে না। মাসে ১৫ হাজার টাকাই হয় না এখন। বাজারে সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। খুব কষ্ট হচ্ছে সংসার চালাতে। আগে যে কিছু সঞ্চয় করেছিলাম, তা-ই ভেঙে খাচ্ছি। কী আর করব বলেন।’

সেলিমের মতো দেশের সব দিনমজুর ও শ্রমিকই এখন কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। করোনায় যারা কাজ হারিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই আর কাজ ফেরত পাননি। কেউ কাজ ফিরে পেলেও মজুরি কম পাচ্ছেন। এর ওপর জিনিসপত্রের বাড়তি দাম ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। সঞ্চয় করা বা জীবনযাত্রার বাড়তি চাহিদা মেটানো তো দূরে থাক, জীবন চালানোই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবও তাই বলছে। সংস্থাটির সবশেষ হিসাবে দেখা যায়, গত ডিসেম্বর শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। আর ওই মাসে মজুরি বেড়েছে ৬ দশমিক ১১ শতাংশ। অর্থাৎ এখন জাতীয় পর্যায়ে মজুরি বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির হার প্রায় সমান হয়ে গেছে। সাধারণত মজুরি বৃদ্ধির হার মূল্যস্ফীতির কিছুটা বেশি থাকে। তবে দুই মাস ধরে সেই চিরায়ত প্রবণতায় টান পড়েছে।

করোনার কারণে সংকটে থাকা ব্যবসা-বাণিজ্যসহ পুরো অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা করার এই প্রক্রিয়ায় মজুরিও বেড়েছে বলে দাবি করছে বিবিএস। তবে সেই বাড়তি মজুরির টাকা খেয়ে ফেলছে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি।

বিষয়টি এভাবে বলা যায়, ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে একজন মানুষ ১০০ টাকায় যত জিনিসপত্র কিনেছেন, ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ওই টাকা দিয়ে সেই জিনিসপত্র পাবেন না। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় আপনাকে ওই একই দ্রব্য কিনতে ১০৬ টাকা ৫ পয়সা খরচ করতে হবে। ৬ টাকা ৫ পয়সা হলো মূল্যস্ফীতি। গত ডিসেম্বর মাসের মূল্যস্ফীতির হার ছিল এটাই।

পরিসংখ্যান ব্যুরো হিসাব বলছে, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মানুষের মজুরিও বেড়েছে। মজুরি বেশি বৃদ্ধি পেলে মূল্যস্ফীতির আঁচ টের পান না তারা। সমান হলে দুশ্চিন্তা বাড়ে। গত ডিসেম্বর মাসে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ১১। এর মানে মজুরি বৃদ্ধির বাড়তি টাকা পুরোটাই চলে গেছে জিনিসপত্রের বাড়তি দামে। ফলে সঞ্চয় করা বা জীবনযাত্রার বাড়তি চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।

তবে বিবিএসের মজুরি বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির এই হারকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতির গবেষকরা। তারা বলেছেন, করোনার ধাক্কা পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। এর মধ্যে দিনমজুর-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পায় কী করে? একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির তথ্য দেয়া হচ্ছে, সেটার সঙ্গে বাজারের চড়া দামের প্রতিফলন নেই।

প্রায় দুই বছরের করোনার কারণে বহু লোকের চাকরি গেছে, অনেকে কাজও হারিয়েছেন। অনেকেই আবার কাজে ফিরেছেন, কিন্তু আগের মজুরি পান না। অনেকে চাকরি বা কাজ হারিয়ে শহর থেকে গ্রামে ফিরে গেছেন। এমন অবস্থায় মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে তারা বেশি হিমশিম খাচ্ছেন। মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে অনেকেই বাড়তি কাজ করছেন।

দেশে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর ২০২০ সালের জুন মাসে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম ছিল। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, আর মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। গত এক দশকের মধ্যে সেটিই ছিল ব্যতিক্রম ঘটনা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত মূল্যস্ফীতি ও মজুরি হার বৃদ্ধির মধ্যে পার্থক্য ১ শতাংশের মতো হয়। কয়েক মাস ধরে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এখন তা ৬ শতাংশ পেরিয়ে গেছে। তবে মজুরি সেই হারে বাড়ছে না। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ও মজুরি সূচক প্রায় সমান্তরালে চলেছে। গত নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। আর মজুরি বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ।

অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরোর মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন আছে। এখন সেই প্রশ্নটা আরও মোটা দাগে চোখে পড়ছে। বিবিএস ডিসেম্বরের মূল্যস্ফীতির যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তার সঙ্গে বাজারের পণ্যমূল্যের বাস্তব প্রতিফলনের যথেষ্ট ঘাটতি যে কারোরই চোখে পড়বে।

‘৫০ টাকার কমে কোনো চাল পাওয়া যায় না বাজারে। ভোজ্যতেল, চিনি, ডালসহ সব জিনিসের দামই চড়া। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে পণ্যমূল্যে। বেড়েছে মানুষের পরিবহন খরচ। এ অবস্থায় ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি নিয়ে প্রশ্ন উঠাটা স্বাভাবিক নয় কী?’

তিনি বলেন, ‘বাজারের পণ্যমূল্য এবং পরিবহনসহ অন্যান্য খরচ যেভাবে বাড়ে, বিবিএসের তথ্যের সঙ্গে তার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় না। সে কারণেই প্রশ্ন ওঠে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য বিবিএসের বাস্তবভিত্তিক তথ্য প্রকাশের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

‘পৃথিবীর সব দেশেই তো এখন মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। বাংলাদেশেও বাড়বে- এটাই স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে প্রকৃত তথ্য উঠে আসা উচিত বলে আমি মনে করি। একই সঙ্গে মহামারির মধ্যে মজুরি বাড়াটাও কিন্তু অনেকের কাছে অবাক লাগছে।’

এই বিষয়ে অর্থনীতির আরেক গবেষক সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এই সময়ে মজুরি হার বৃদ্ধির কোনো কারণ আমি খুঁজে পাই না। সাধারণত যখন শ্রমিকের চাহিদা বাড়ে, সরবরাহ কম থাকে, তখন মজুরি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই মহামারির সময়ে শ্রমিকের চাহিদা বেশ কমেছে। অনানুষ্ঠানিক খাতে বেকারের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তাহলে মজুরি বাড়ল কোন ভিত্তিতে?’

তিনি বলেন, ‘মহামারির ধকল কিন্তু এখনও পুরোপুরি সামলে ওঠেনি বাংলাদেশ। এর মধ্যে কোনো শ্রমিক-দিনমজুরেরই মজুরি বাড়ার কথা নয়। এ বিষয়গুলো বিবিএসের বিচেনায় নেয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’

সেলিম রায়হান বলেন, ‘তারপরও বিবিএসের বর্তমান মূল্যস্ফীতি ও মজুরি সূচকের তথ্য নিয়েই যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলেও কিন্তু আমরা উদ্বেগজনক একটি তথ্য দেখতে পাচ্ছি। আর সেটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি প্রকৃত মজুরির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে। অর্থাৎ বাস্তবে আয় বাড়লেও মূল্যস্ফীতি তা খেয়ে ফেলেছে।’

বর্তমান মূল্যস্ফীতি ও মজুরি সূচকের হার প্রসঙ্গে বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা মাঠপর্যায় থেকে যে তথ্য পাই, সেটাই প্রকাশ করি।’

বিবিএস প্রতি মাসে কৃষিশ্রমিক, পরিবহনকর্মী, বিড়িশ্রমিক, জেলে, দিনমজুর, নির্মাণশ্রমিকসহ ৪৪ ধরনের পেশাজীবীর মজুরির তথ্য সংগ্রহ করে মজুরির হার সূচক তৈরি করে। এসব পেশাজীবীর মজুরি খুব কম এবং দক্ষতাও কম। শুধু দৈনিক ভিত্তিতে মজুরি পান বা নগদ টাকার পরিবর্তে অন্য সহায়তা পান, তার ভিত্তিতে কোন মাসে মজুরি হার কত বাড়ল, তা প্রকাশ করে বিবিএস।

পরিসংখ্যান ব্যুরো যে ৪৪ ধরনের পেশাজীবীর মজুরির তথ্য নেয়, তার মধ্যে ২২টি শিল্প খাতের এবং ১১টি করে কৃষি ও সেবা খাতের পেশা। বেতনভোগী কিংবা উচ্চ আয়ের পেশাজীবীদের বিবিএসের মজুরি সূচকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের কর্মসংস্থানের বড় অংশই হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে। মোট শ্রমশক্তির ৮৫ দশমিক ১ শতাংশই এ খাতে নিয়োজিত। আর ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে।

অন্যদিকে কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত মোট শ্রমশক্তির ৯৫ দশমিক ৪ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। শিল্প খাতের ৮৯ দশমিক ৯ শতাংশ, সেবা খাতের ৭১ দশমিক ৮ শতাংশ শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত।

এ বিভাগের আরো খবর