ফসলের বিশাল মাঠ। ধান উঠে যাওয়ায় মাঠ এখন ফাঁকা। সেখানে জ্বলছে সারি সারি চুলা।
কিছুদূর পর পর দল বেঁধে কেউ রান্না করছেন, কেউ করছেন জোগাড়। দূর থেকে দেখে মনে হতে পারে মাঠ যেন বিশাল এক রান্নাঘর।
এ দৃশ্য দেখা গেছে শুক্রবার রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৌতন্যপুর গ্রামে। এ আয়োজন হিন্দু সম্প্রদায়ের, অনেকটা পিকনিকের মতো। স্থানীয়ভাবে একে বলে ভুকরাভাত। মূলত পৌষ উৎসবই এটি।
ভুকরাভাতের দিন পূজা অর্চনা শেষে হিন্দুরা সকাল থেকে মাঠে মাটির চুলা তৈরি ও রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত থাকেন। কেউ আনেন খড়ি বা জ্বালানি, কেউ পানি, কেউ আনেন খাদ্যপণ্য। দলে দলে ভাগ হয়ে তারা রান্না করেন।
মাঠে যেতেই দেখা মিলল একটি দলের। তাতে আছেন দিপ্তি, দিপালী, শিখা, টুম্পাসহ প্রায় ১৫ থেকে ১৬ জন। এর মধ্যে দিপ্তি লুচি ভাজছেন, তাকে লুচি বানিয়ে দিচ্ছেন শিখা, টুম্পা ও অনন্যা। আরেক চুলায় দিপালী ভাত চড়িয়েছেন।
দিপালী বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকেই পৌষ মাসের শেষ দিনে এমন আয়োজন করে থাকি। পৌষ মাসের শুরুর দিনেই আমার টুস পূজা করি। সেটি ৩০ তারিখে বিসর্জন দিয়ে সকালে স্নান করে এখানে একসঙ্গে মিলে আনন্দ করে খাই। আমরা কিছু কিছু করে টাকা তুলে আর সবার বাড়ি থেকে চাল-ডাল তুলে এই ভুকরাভাত করি।’
লুচি ভাজতে ভাজতে দিপ্তি বললেন, ‘এটা আমাদের কাছে অনেক আনন্দের দিন। এই দিনেই আমরা বাড়ির বাইরে আনন্দ করে খেয়ে থাকি। প্রতি বছরই এই দিনে আমরা মাঠে একসঙ্গে নেচে-গেয়ে খেয়ে আনন্দ করি।’
একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখা হয় আরেক দলের সঙ্গে। তাদের মধ্যে কয়েকজন রান্না করছেন, কয়েকজন গান বাজিয়ে নাচছেন। মাঠজুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে শিশুরা।
রান্না শেষ হতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। পুকুর থেকে তুলে আনা শাপলাপাতা বিছিয়ে সাড়ে ৪টার দিকে সবাই মিলে খেতে বসে। তাদের তৈরি নানা পদের মধ্যে আছে বুন্দিয়া, লুচি, ভাত, মুরগির মাংস, ডাল ও দই।
ভুকরাভাতে আসা জয় চাঁদ মণ্ডল বলেন, ‘এই দিনের প্রস্তুতি শুরু হয় এক মাস আগে থেকে। এই দিনে মূলত পূজার পরই আনন্দ শুরু হয়। একে আমরা পৌষ পর্বও বলে থাকি। আমাদের বিশ্বাস, এই পূজা আর উৎসবের মাধ্যমে অসুখ থেকে মুক্তি মেলে। এটা আমাদের বাপ-দাদার আমল থেকেই হয়ে আসছে। এখন আমরা করছি। আমাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিরা করছে।’
ভুকরাভাতের আয়োজন শেষ হয় গোধূলীলগ্নে, কিশোর-তরুণদের নাচ-গানের মধ্য দিয়ে। সূর্য ডুবে যাওয়ার পর যে যার মতো হাঁড়ি-পাতিল গুটিয়ে বাড়ি ফিরতে শুরু করেন।