দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার হালজায় ঝিনাইকুড়ি গ্রামের অবস্থান। প্রায় সাড়ে তিন শ একর এলাকাজুড়ে এ গ্রামে কড়া সম্প্রদায়ের ২৪টি পরিবারের বসবাস। এ সম্প্রদায়ের রাজা পারু রাজা বৃটিশ আমলে এ জমিগুলো কড়া সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাসের জন্য দিয়ে যান। এরপর থেকেই তারা এখানে বাসবাস করছেন। বর্তমানে ২৪টি পরিবারের সদস্য ৯৪ জন।
তবে, কেউ শিক্ষার আলোয় সেভাবে কেউ আলোকিত হতে পারেননি। দুই বছর আগেও কেউ উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেননি।
সেই অতীতকে এবার পিছনে ফেলেছেন দিনাজপুরের ঝিনাইকুড়ি গ্রামের লাপোল কড়া। উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। সম্প্রতি গুচ্ছ পরীক্ষায় কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে ১৫তম স্থানে জায়গা করে নিয়েছেন লাপোল কড়া। তিনি ঝিনাইকুড়ি গ্রামের মৃত রতন কড়ার ছেলে। মা সাতোল কড়া একজন কৃষাণি।
কড়া সম্প্রদায়ের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে; এই খবরে আনন্দের বন্যা বইছে সবার মাঝে। লাপোল কড়ার মতো এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার স্বপ্ন দেখছে এ সম্প্রদায়ের আরও অনেক ছেলে-মেয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলেও পড়াশোনার খরচ কীভাবে জোগাড় হবে, সেই চিন্তা এখন লাপোল কড়ার মাথায়।
ঝিনাইকুড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এখানকার সম্প্রদায়ের সবার মুখে মুখে লাপোল কড়ার নাম। একসঙ্গে ২-৪ জনের জটলা বাধলেই গল্পের বিষয় হয়ে উঠে লোপাল কড়া। নানা প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে পা রাখা লাপোলকে নিয়ে গর্বিত এলাকাবাসী।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়া লাপোল কড়ার এক ভাই ও এক বোন। বড় ভাই সাপোল কড়া পড়াশোনা করেছেন দশম শ্রেণি পর্যন্ত। আর ছোট বোন পূর্ণিমা কড়া পড়ছেন অষ্টম শ্রেণিতে। ভাই লাপোল কড়ার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখছেন পূর্ণিমা কড়াও।
নানা কারণে পড়ালেখা ছেড়ে দেয়ার চিন্তা করা ছেলে-মেয়েরাও এখন পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়েছে। অজয় কড়া, পূজা কড়া, গীতা কড়া, সুমি কড়া, রিদয় কড়া, মুক্তা কড়ার মতো আরও অনেকের চোখেমুখে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন।
নিউজবাংলাকে দশম শ্রেণির ছাত্র জয়ন্ত কড়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লাপোল কড়া আমার এলাকার বড় ভাই। বিভিন্ন কারণে বাইরের স্কুল বা কলেজে পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করে না। বাইরে পড়াশোনা করতে গেলে আমাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যভাবে কথা বলে। নানাভাবে অপমান করে। মাঝেমধ্যে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। কিন্তু সব ধরনের প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে লাপোল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, এই জন্য আমার খুব আনন্দ লাগছে।
‘আমিও ভালোভাবে পড়ালেখা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হব। আমাদের কড়া সম্প্রদায়ের নানা অবহেলা ও সমস্যার কথা সমাজের সামনে তুলে ধরব।’
লাপোল কড়ার বড় ভাই সাপোল কড়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০১২ সালের দিকে আমি দশম শ্রেণির মডেল টেস্ট পরীক্ষা দিতে পারি নাই। পরের বছর বিদ্যালয়ে গেলে শিক্ষকরা আমাকে আর ভর্তি নেয় নাই। তাই আর পড়তে পারি নাই।
‘আমরা বিদ্যালয়ে পড়তে গেলে আমাদের বিভিন্ন ধরনে কথা-বার্তা শুনতে হয়। নানাভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। সবাই আমাদের দেখে ঘৃণার চোখে দেখে। এই অবস্থায় পড়লে যেকোনো মানুষই পড়ালেখা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। তারপরও আমার ছোট ভাই সব বাধা-বিপত্তি পার করে পড়াশোনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলো, এতে আমার সম্প্রদায়ের সবাই খুব খুশি।’
যাকে নিয়ে এ আনন্দের জোয়ার সেই লাপোল কড়া শোনালেন নিজেদের অবহেলা আর বঞ্ছনার কথা। বলেন, ‘নানা সময়ে সমাজে আদিবাসীদের সাথে জমি নিয়ে অন্যায় করা হয়। অনেক সময় আদিবাসীদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। আমরা ঠিকমত বিচার পাই না।
‘অনেক সময় আমাদের খোলা আকাশের নিচে বসবাস করতে হয়েছে। আমি নাট্যকলা বিভাগে পড়ব। এই নাট্যকলার নাটকের মাধ্যমে আমাদের কড়া সম্প্রদায়ের অবহেলা ও সমস্যার কথা সমাজের সামনে তুলে ধরব।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কি, প্রথমে আমি ঠিকমতো বুঝতাম না। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানতে পারছি। এখন মনে হচ্ছে, আগে অন্ধকার জগতে ছিলাম। এখন আলোর জগতে যাচ্ছি। এ সব দেখে আমার পড়ালেখার প্রতি আরও আগ্রহ জেগে গেছে। আমি চাই কড়া সম্প্রদায়ের আরও সন্তান ভালোভাবে পড়ালেখা করে আমার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হোক।’
নিজের মতো সম্প্রদায়ের অন্য শিক্ষার্থীদেরও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে, এমন স্বপ্ন দেখলেও নিজের পড়াশোনার খরচ নিয়ে যেনো অন্ধকারে তিনি।
বলেন, ‘যখন আমি নবম শ্রেণিতে, তখন বাবা মারা গেছেন। তারপরও সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতায় আমি পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার মত আমার কোন সামর্থ্য নেই। যদি কোনো বিত্তবান আমাকে সহযোগিতা করে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ভালোভাবে করতে পারব।’
নিউজবাংলাকে লাপোল কড়ার মা সাতোল কড়া বলেন, ‘ছেলে ঢাকায় গিয়ে পড়ালেখা করবে, এই জন্য খুব ভালো লাগতেছে। জীবনে আমি কোনো দিন স্কুলে যাই নাই। গ্রামের আর বাইরের লোকজন জানবে, কড়া সম্প্রদায়ের কেউ ঢাকায় গিয়ে পড়ালেখা করতেছে।
‘তবে শুধু আমার ছেলেই নয়, গ্রামের অন্য সন্তানরাও যাতে বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করতে পারে এটাই আমি আশা করি।’