প্রণোদনার প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ঋণে নয়ছয় করেছে বেসরকারি এবি ব্যাংক লিমিটেড। মন্দ ঋণ থাকার পরও সেই প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ ছাড় করেছে ব্যাংক।
এ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান ওই অর্থ দিয়ে পরিশোধ করেছে আগের ঋণ। গ্রাহকের ঋণ আদায় ওভারডিউ থাকার পরও তাদের নামেই ছাড় হয়েছে টাকা। মাসে কমপক্ষে একবার ঋণগ্রহীতা গ্রাহকের প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের নিয়ম থাকলেও সেটা পালন করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন নানা অনিয়মের চিত্র।
করোনা মহামারির বিপর্যয় কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা সুবিধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বিশেষ সুবিধায় জোগান দেয়া হয় অর্থ। তবে সেই অর্থ বণ্টনের ক্ষেত্রে হরহামেশাই অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয় এবি ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, এবি ব্যাংক ঋণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেনি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম মনে করেন, প্রণোদনার ঋণ বণ্টনের ক্ষেত্রে আরও স্বচ্ছতা দরকার। তিনি বলেন, সঠিক ব্যক্তি নির্বাচন এবং অর্থ ব্যবহারের দিকটি তদারকি করতে হবে। ব্যাংকগুলোর মধ্যে সুশাসনের অভাবের কারণেই অর্থ ছাড় করার ক্ষেত্রে এমন অভিযোগ ওঠে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন
এবি ব্যাংকের প্রণোদনার ঋণের সদ্ব্যবহার যাচাই করতে সরেজমিন বিশেষ পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত বছরের ১২ আগস্ট প্রথম ধাপে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
পরে ২৯ আগস্ট শাখা পর্যায়ে পরিদর্শন শুরু হয়। প্রধান কার্যালয়সহ উত্তরা, মতিঝিল, প্রিন্সিপাল শাখা, কারওয়ান বাজার, কাকরাইলসহ মোট পাঁচটি শাখায় ১৭টি ভিন্ন ভিন্ন গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের ওপর পরিদর্শন পরিচালনা করা হয়। প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় এবি ব্যাংক ৩৪ জন ঋণগ্রহীতাকে ২৯৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
যে ১৭ প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম
এবি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখা থেকে এনার্জিপ্যাক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে গত বছর ৫ জানুয়ারি থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত ঋণের ২২ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। ৫ জানুয়ারি ৮ কোটি টাকা ঋণ ছাড়ের পর গ্রাহক টাকা তার ওডি হিসেবে স্থানান্তর করে। ওই দিন ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকার এলসি দায় শোধ করে।
গত বছরের ১৮ জানুয়ারি ঋণের ১ কোটি টাকা ছাড়ের পর ওই দিন গ্রাহক আবার ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার এলসি দায় শোধ করেন।
১৯ জানুয়ারি ১ কোটি টাকা ঋণ ছাড়ের পর একইভাবে গ্রাহক ২ কোটি ৫ লাখ টাকার এলসি দায় শোধ করে।
ওই বছরের ২৫ জানুয়ারি আরও ১ কোটি টাকা ঋণ ছাড়ের পর সেই টাকা গ্রাহক ২৭ জানুয়ারি ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের হিসেবে স্থানান্তর করে। এভাবে একের পর এক ঋণের টাকা দিয়ে গ্রাহক ব্যাংকের বিভিন্ন দায় শোধ করেছে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা রয়েছে, এ ঋণ দিয়ে অন্য কোনো ঋণ শোধ করা যাবে না।
একই শাখায় বাংলা ফিড মিলকে দেয়া হয় ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঋণ। হিসাব বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঋণ পেয়েই গ্রাহক সঙ্গে সঙ্গে পুরো টাকা একটি চেকের মাধ্যমে নগদ উত্তোলন করে। টাকা উঠানোর পর গ্রাহক কী কাজে সেই অর্থ ব্যবহার করেছেন বা আদৌ অর্থের সদ্ব্যবহার করেছেন কিনা তার কোনো প্রমাণ ব্যাংকের শাখা সংরক্ষণ করেনি।
আবার একই শাখা থেকে নিট এশিয়া লিমিটেডকে দেয়া হয় ৩ কোটি ৩০ লাখ টাকার ঋণ। এ ঋণের পুরো টাকা তিন ধাপে আরেকটি ব্যাংকে স্থানান্তর করে গ্রাহক। ফলে সেই টাকা গ্রাহক কী করেছে, ব্যাংকের শাখায় তার কোনো প্রমাণ নেই।
প্রিন্সিপাল শাখা থেকেই রহিম টেক্সটাইল মিলসকে দেয়া হয় ১ কোটি ২০ লাখ টাকার ঋণ। ঋণ পাওয়ার তিন দিন পর গ্রাহক পুরো টাকা মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকে স্থানান্তর করে। পরে সেই টাকা কী কাজে ব্যবহার করা হয়েছে, ব্যাংক সেটা জানে না।
ব্যাংকের উত্তরা শাখা থেকে আলেমা টেক্সটাইল লিমিটেডকে ১০ কোটি ৪১ লাখ টাকার ঋণ গ্রাহকের ওভারড্রাফট হিসেবে দেয়া হয়েছে। ওভারড্রাফট ঋণের সীমা ছিল ৫ কোটি টাকা। ঋণ দেয়ার আগে স্থিতি ছিল ৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। ঋণ স্থানান্তরের পরে স্থিতি দাঁড়ায় ৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। গ্রাহকের হিসাব বিবরণী পর্যালোচনায় ঋণের অর্থ দিয়ে গ্রাহক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মেয়াদি লোন ও এলসি সমন্বয় করেছেন বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বরের সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) রিপোর্ট অনুযায়ী, গ্রাহকের বিপুল পরিমাণ ঋণ দায় ওভারডিউ এবং মন্দমানের ঋণ (কু-ঋণ) থাকার পরও গ্রাহককে প্রণোদনার ঋণ দেয়া হয়েছে।
এ ঋণ প্রস্তাবের সময় গ্রাহকের গ্রুপভিত্তিক ফান্ডেড ঋণ ছিল ৩৩ কোটি ও নন-ফান্ডেড ঋণ ছিল ১৬ কোটি টাকা। এর বিপরীতে জামানত ছিল ৯৪ কোটি টাকা।
একই শাখা থেকে মিম ডিজাইন লিমিটেডকে দেয়া হয় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঋণ। ঋণ পাওয়ার দুই দিন পরই গ্রাহক ঋণের টাকা নগদ উত্তোলন করে এবং একই দিন ৭১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা করে। পরবর্তী সময়ে অন্য একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ৮০ লাখ টাকা জমা করা হয়, যা দিয়ে বিভিন্ন টাইমে লোন ও এলসির দায় শোধ করেছে গ্রাহক।
গ্রাহক অতি চতুরতায় প্রণোদনার ঋণ দিয়ে ব্যাংকের বিভিন্ন ঋণ শোধ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, প্রণোদনার ঋণ নিয়ে অন্য কোনো ঋণ শোধ না করার যে নির্দেশনা রয়েছে, সেটা লঙ্ঘন করা হয়েছে।
ঋণ প্রস্তাবের সময় ওই গ্রাহকের মোট ঋণ দায়ের ৫ কোটি ৬ লাখ টাকা ওভারডিউ ছিল। সিআইবি রিপোর্টে এ দায় সাবস্ট্যান্ডার্ড (এসএমএ) মান এবং ঋণ নথিতে ঘাটতি ছিল।
ভি অ্যান্ড আর ফ্যাশন লিমিটেডকে মতিঝিল শাখা থেকে ৪ কোটি ৯৬ লাখ টাকার ঋণ দেয়া হয়। ঋণ পাওয়ার দিনই গ্রাহক ওই টাকা দিয়ে ২ কোটি টাকার টাইম লোন সমন্বয় ও এলসি দায় শোধ করে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। পরের দিন ৯৫ লাখ টাকা ঢাকা ব্যাংকে স্থানান্তর করে এবং এই টাকা দিয়েও বিভিন্ন ঋণ পরিশোধ করে। ঋণ প্রস্তাবের সময় গ্রাহকের সীমাতিরিক্ত ঋণ থাকার পরও তাকে ঋণ দেয়া হয়েছে।
ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখা থেকে নেট ওয়ার্ল্ড টেকনোলজি লিমিটেডকে দেয়া হয় ১০ কোটি ৮ লাখ টাকার ঋণ। ঋণের পুরো টাকা গ্রাহক ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে আল-আরাফাহ ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী ও ইউনাউটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে স্থানান্তর করে।
সিআইবি রিপোর্টে বলা হয়েছে, গ্রাহকের দায় সাবস্ট্যান্ডার্ড মান এবং বিপুল ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ থাকার পরও ঋণ দেয়া হয়েছে।
একই শাখা থেকে নেট ওয়ার্ল্ড বিডি লিমিটেডকে দেয়া হয়েছে ৭ কোটি ২০ লাখ টাকার ঋণ। ঋণ পাওয়ার পরপরই গ্রাহক পুরো টাকা আল-আরাফাহ ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে স্থানান্তর করে। পরবর্তী সময়ে প্রায় এক সপ্তাহ পর ৯ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ওই দুই ব্যাংকসহ এসআইবিএল থেকে ক্লিয়ারিংয়ের মাধ্যমে এবি ব্যাংকের কারওয়ান বাজার শাখায় স্থানান্তর করা হয়। এখানেও গ্রাহকের বিপুল ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ থাকার পরও ঋণ দেয়া হয়েছে।
প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় সিম্পল সল্যুশন (প্রা.) লিমিটেডকে একই শাখা থেকে ৩ কোটি ৯০ লাখ টাকার ঋণ দেয়া হয়। একইভাবে ঋণ ছাড়ের পর গ্রাহক পুরো টাকা আল-আরাফাহ ব্যাংকে স্থানান্তর করে। পরবর্তীকালে গ্রাহকের সহযোগী হিসাব থেকে সমপরিমাণ টাকা কারওয়ান বাজার শাখায় স্থানান্তর করা হয়। এখানে গ্রাহক তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন টাইম লোন ও এলসি দায় শোধ করেছে বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে।
কারওয়ান বাজার শাখা থেকে আরও অনিয়ম পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ শাখা থেকে সেট ওয়ার্ল্ড সার্ভিস লিমিটেডকে দেয়া হয় ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকার ঋণ। একইভাবে ঋণের টাকা গ্রাহক এসআইবিএল ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে স্থানান্তর করে এবং পরবর্তী সময়ে সহযোগী প্রতিষ্ঠানের হিসাব থেকে এবি ব্যাংকের শাখায় আবার স্থানান্তর করে।
একই শাখা থেকে ইবিডি লিমিটেড পেয়েছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার ঋণ। একইভাবে ওয়ার্ল্ড রানার এক্সপ্রেস লিমিটেডকে দেয়া হয় ৬০ লাখ টাকা। সি চেইন লজিস্টিককে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা প্রণোদনার অর্থ দেয়া হয়। তিনটি প্রতিষ্ঠানই ঋণের টাকা তুলে আল আরাফাহ ব্যাংকে স্থানান্তর করে। পরে ওই টাকা কোন খাতে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা ব্যাংকের শাখা জানে না।
কাকরাইল শাখা থেকে ১২ কোটি টাকা ঋণ পায় টেকনো ড্রাগস লিমিটেড। ঋণ ছাড়ের পরপরই গ্রাহক ৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা তার এসওডি হিসাবে স্থানান্তর করে। অবশিষ্ট টাকা গ্রাহক ব্যাংকের বিভিন্ন ফোর্সড ঋণ সমন্বয় করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ
ঋণ মঞ্জুরকালীন সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) রিপোর্টে বলা হয়েছে, মন্দ ঋণ থাকার পরও গ্রাহককে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ দেয়া হয়, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা এবং ব্যাংক কোম্পানি ১৯৯১-এর ২৭ (কক)(৩) ধারার লঙ্ঘন।
১৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০টি প্রতিষ্ঠানই প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণের অর্থ নিয়ে তার নিজের অথবা সহযোগী প্রতিষ্ঠানের পূর্বের ঋণ পরিশোধ করেছে।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, গ্রাহকদের বিপুল পরিমাণ ঋণ আদায় ওভারডিউ থাকার পরও তাদের প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ দেয়া হয়েছে।
ব্যাংকের অনুমোদনপত্রের শর্তানুসারে ঋণ তদারকির অংশ হিসেবে মাসে কমপক্ষে একবার গ্রাহকের প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের উল্লেখ থাকলেও কোনো গ্রাহকের ক্ষেত্রেই তা পালন করা হয়নি।
ঋণ বিতরণের পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঋণের অর্থ অন্য ব্যাংকে স্থানান্তর করা হয়েছে। ফলে ব্যাংকটি ঋণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেনি।
গ্রাহক অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রণোদনার ঋণের অর্থ সহায়তা পেয়েছে কি না, তা শাখা কর্তৃক নিশ্চিত করা হয়নি।
যা বলছে এবি ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য সঠিক নয় বলে মনে করেন এবি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর তারিক আফজাল। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের এ অবজারভেশন ডকুমেন্টেড নয়। এ তথ্য সঠিক নয়। কারণ সিআইবি রিপোর্টে খেলাপি বা মন্দ মান থাকলে সেই গ্রাহককে ঋণ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
প্রণোদনা ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রণোদনার ঋণ নিয়ে অনেক ব্যাংক এমন ধরনের কাজ করছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পরিদর্শনে উঠে এসেছে। কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে ঋণের টাকা অপব্যবহার বা সঠিক ব্যবহার হয়নি এমন প্রমাণ মিললে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে প্রণোদনার ঋণের বিপরীতে দেয়া সুবিধা বাতিল করা হবে। যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’