দেশে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের বিস্তার রোধে সরকার ঘোষিত ১১ দফা বিধিনিষেধ কার্যকর হচ্ছে আজ থেকে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মানতে হবে এসব বিধিনিষেধ। নির্দেশনা বাস্তবায়নে কোনো ব্যত্যয় হলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থার হুশিয়ারি রয়েছে।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, করোনার বিস্তার রোধে এটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। তবে অতীতের মতো দায়সারা নির্দেশনা দিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ না করলে জনসম্পৃক্তকরণে চ্যালেঞ্জ বাড়বে। একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে কাজ না করলে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানানো কষ্টকর হবে। একইসঙ্গে বাড়বে জনসাধারণের ভোগান্তি।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বাস ও ট্রেনে অর্ধেক যাত্রী বহন করতে হবে। এর আগে গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের নির্দেশ এসেছে তিন দফা। দেখা গেছে, কিছুদিন যাত্রী অর্ধেক তুললেও পরে প্রতি আসনেই এমনকি দাঁড়িয়েও যাত্রী বহন করা হয়েছে, কিন্তু ভাড়া আদায় করা হয়েছে বেশি।
ট্রেনে অর্ধেক যাত্রী বহন করা হলেও জনগণের চলাচলে বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় তাদেরকে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।
করোনায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নজরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে টিকা কার্ড লাগবে বলা হচ্ছে। এই টিকা কার্ড কারা কিভাবে দেখবে এটা সুস্পষ্ট করে বিধিনিষেধে উল্লেখ নেই।
এদিকে হোটেল মালিকদের শঙ্কা, এমন নির্দেশনায়তাদের বেচাবিক্রি কমে যাবে।
করোনা মহামারির আঘাতে রেস্তোরাঁ খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার। ছবি: সংগৃহীত
এছাড়া বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতজন সদস্য কোথায় কিভাবে দায়িত্ব পালন করবেন এ বিষয়টিও পরিষ্কার নয়। এসব বিষয় আগেভাগে স্পষ্ট করলে জনগণ সচেতন হওয়ার সুযোগ পেত।
একাধিক বিশেষজ্ঞ বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে যে দেশে চলতি বছরের প্রথম দিন থেকেই করোনা সংক্রমণ ক্রমাগত বাড়ছে। গত এক সপ্তাহে রোগী শনাক্তের হার বেড়েছে ১৬৯ শতাংশ।
ডিসেম্বর মাসে মাত্র ৪ হাজার ৫৮৮ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। সেখানে চলতি মাসের ১১ দিনে এই সংখ্যা ১২ হাজার ৮৫০ জনে পৌঁছেছে। পরিস্থিতির কারণে ইতোমধ্যে স্বাস্থ্যবিভাগ সারা দেশে সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকি, মধ্যম ঝুঁকি ও কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন জানান, সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী ধারা বিবেচনায় ঢাকা ও রাঙ্গামাটি জেলাকে রেড জোন অর্থাৎ উচ্চ ঝুঁকির কাতারে ফেলা হয়েছে। হলুদ জোন বা মধ্যম ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে ছয়টি জেলা। বাকি ৫৪টি জেলা কম ঝুঁকি অর্থাৎ সবুজ জোনে রয়েছে।
অধিদপ্তরের এই মুখপাত্র বলেন, ‘দেশে গত এক সপ্তাহে শনাক্তের হার দ্বিগুণ হয়েছে। ৫ জানুয়ারি শনাক্তের হার ছিল ৪ দশমিক ২০ শতাংশ। ১২ জানুয়ারি তা বেড়ে ১১ দশমিক ৯৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অথচ বর্তমান পরিস্থিতিতে উপসর্গ দেখা দেয়ার পর করোনা পরীক্ষা করা জরুরি হলেও অনেকেই তা করাচ্ছেন না। পরীক্ষা বেশি হলে রোগীর সংখ্যা ও সংক্রমণের হার আরও অনেক বেশি হতো।
সংক্রমণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ১ জানুয়ারি পর্যন্ত করোনা নিয়ন্ত্রণে ছিল। এরপর থেকে সংক্রমণের হার ক্রমাগত বাড়ছে। কোনো নির্দিষ্ট ধারায় তা বৃদ্ধি পাচ্ছে না, যা খুবই আতঙ্কের বিষয়। গত এক সপ্তাহে করোনা পরীক্ষা ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ এই সময়ে দেড় লাখেরও বেশি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পূর্ববর্তী সপ্তাহের চেয়ে ৬ হাজারেরও বেশি (১৬৯ শতাংশের বেশি) রোগী শনাক্ত হয়েছে।
অন্যদিকে সম্প্রতি যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে তাতে মনে হচ্ছে দেশে ওমিক্রনের গুচ্ছ সংক্রমণ চলছে। ঢাকা ও রাঙ্গামাটি জেলায় সংক্রমণের হার তেমনটাই নির্দেশ করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, ‘দেশে গত ১০ ডিসেম্বর প্রথম ওমিক্রন শনাক্ত হয়। কিন্তু ধরনটির জিন বিশ্লেষণ কম হচ্ছে। ৫০০ জন শনাক্ত রোগীর মধ্যে মাত্র একজনের নমুনার জিন বিশ্লেষণ হয়েছে। এতো কমসংখ্যক নমুনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোন ধরন কী সংখ্যায় ছড়াচ্ছে তা বলা মুশকিল হয়ে পড়েছে। ফলে সংক্রমণের এই বৃদ্ধি করোনার অতিসংক্রামক ধরনের কারণে নাকি অন্য কারণে হচ্ছে- তা এখনো স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।
বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোনো পদক্ষেপ বাস্তবায়নযোগ্য না হলে এক পর্যায়ে তা শুধুই প্রজ্ঞাপন জারি হিসেবে থেকে যায়। তাতে করে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জনগণের আস্থা কমে যায়। এখন প্রশ্ন হলো- বিধিনিষেধগুলো বাস্তবায়নে সমন্বয় রয়েছে কিনা। কারণ কোনো কিছু মানতে বলা হলে বিকল্প সুবিধাগুলো করে দিতে হবে।
‘উন্মুক্ত স্থানে সব ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, জনসমাগম বন্ধ থাকবে বলা হচ্ছে। অথচ একই সময়ে আন্তর্জাতিক ব্যাণিজ্য মেলা, ইউনিয়ন পরিষদ ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে গণসংযোগ চলছে।’
প্রজ্ঞাপনে বাজার-ঘাট ও অফিস-আদালতে মাস্ক না পরলে আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে ব্যত্যয় রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। রেস্তোরাঁয় খাবার গ্রহণ এবং আবাসিক হোটেলে থাকতে অবশ্যই টিকা সনদ দেখাতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন ও মাস্ক পরার বিষয়ে মসজিদে মসজিদে জুমার নামাজের খুতবায় ইমামরা সংশ্লিষ্টদর সচেতন করবেন। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
এভাবে ১১টি দফা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রায় সব ক্ষেত্রেই তা পরিবেশ ও মানুষের জীবন-যাপনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দেখা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সমন্বিত কার্যক্রম ও জনসম্পৃক্তকরণ সম্ভব না হলে করোনা নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জ বাড়বে।