বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভর্তুকির চাপে বেকায়দায় সরকার

  •    
  • ১১ জানুয়ারি, ২০২২ ০৮:২০

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন- আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সার, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস- এলএনজি ও জ্বালানি তেলের দাম যে পর্যায়ে চলে গেছে, তাতে দেশে ওইসব পণ্যের দাম না বাড়ালে অর্থবছর শেষে ভর্তুকি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এতে করে বাড়বে বাজেট ঘাটতি। বিরূপ প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে। কষ্ট বাড়বে সাধারণ মানুষের।

আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে দেশের অর্থনীতিতে ভর্তুকির চাপ বাড়ছে। চাপটা এত বেশি যে তা সামাল দেয়া সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। একদিকে সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর চাপ, অন্যদিকে বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখা- এই দুই চাপ সামলাতে বেকায়দায় সরকার।

গত জুনে চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় বিশ্ব পরিস্থিতি অনুকূলে থাকায় ভর্তুকি খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয় ৪৯ হাজার কোটি টাকা। পরিস্থিতি ক্রমে প্রতিকূল হয়ে ওঠায় ভর্তুকির অঙ্ক ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে গেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা হিসাব করে দেখেছেন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সার, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস- এলএনজি ও জ্বালানি তেলের দাম যে পর্যায়ে চলে গেছে তাতে দেশে ওইসব পণ্যের দাম না বাড়ালে অর্থবছর শেষে ভর্তুকি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এতে করে বাড়বে বাজেট ঘাটতি। বিরূপ প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতিতে। কষ্ট বাড়বে সাধারণ মানুষের। চাপে পড়বে দেশের অর্থনীতি।

এবার ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বিশাল বাজেটে ঘাটতি দুই লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা শতকরা হারে মোট জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ। এই ঘাটতি এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ।

অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট ঘাটতি ৬ শতাংশের নিচে রাখতে চায়। এটা করতে হলে সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই। অন্যথায় ঘাটতি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

গত মাসের শেষের দিকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সর্বোচ্চ ফোরাম জাতীয় কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের বৈঠকে অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়।

মূলত ভর্তুকির চাপ সহনীয় রাখতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এ প্রস্তাব করা হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখছে।

ফেব্রুয়ারিতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম না বাড়ালে ভর্তুকি বাবদ বর্তমানের চেয়ে অতিরিক্ত ১০ হাজার কোটি টাকা লাগবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, সার, বিদ্যুৎ, গ্যাসের দাম সমন্বয় করতে পারলে ভর্তুকির চাপ কিছুটা কমবে। তা সম্ভব না হলে ভর্তুকি বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ হবে। সরকারের পক্ষে এত টাকা জোগান দেয়া সম্ভব নয়। কাজেই এসব পণ্যের দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই।

অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, সার অত্যন্ত স্পর্শকাতর পণ্য। এর দাম বাড়ালে কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। এ অবস্থায় সারের দাম না-ও বাড়াতে পারে সরকার। বাকি দুটি সেবা বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম যে বাড়ছে সে বিষয়ে নিশ্চিত বলা যায়। যদিও অর্থ বিভাগ তিনটি খাতেই দাম সমন্বয়ের সুপারিশ করেছে।

চলতি অর্থবছরের বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকি দেয়া হয় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ বরাদ্দটা প্রধানত সার আমদানিতে। সরকার বেশি দামে সার কিনে ডিলারের মাধ্যমে কম দামে কৃষকের কাছে বিক্রি করে থাকে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং অধিশাখা সম্প্রতি অর্থ বিভাগকে জানিয়ে দিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে চলতি অর্থবছরে সার বাবদ ২২ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকির প্রয়োজন হতে পারে।

বিশ্ববাজারে এলএনজির দামও অনেক বেড়েছে। আমদানি করা এলএনজির সঙ্গে দেশীয় গ্যাসের মিশ্রণে প্রতি ঘনফুটের খরচ পড়ে ২২ টাকা। অথচ দেশের বাজারে তা বিক্রি করতে হচ্ছে সর্বোচ্চ ৯ টাকা দরে।

আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বেড়ে চলেছে। ফলে প্রতি ঘনফুট এলএনজির মূল্য ৩০ টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় এলএনজি খাতে ভর্তুকি আরও বাড়বে বলে জানিয়েছে অর্থ বিভাগ।

জ্বালানি খাতে আরও বেশি ভর্তুকির প্রয়োজন হবে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি খাতে ভর্তুকি ধরা রয়েছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারের যে অবস্থা তাতে এই ভর্তুকিতে কুলানো সম্ভব হবে না। কারণ চলতি অর্থবছরের শুরুতে যেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম ছিল ৪৫ ডলার সেখানে সেই তেল এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ ডলারে।

জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে বছর শেষে জ্বালানি খাতে বাড়তি ১০ হাজার কোটি টাকা এবং এলএনজি খাতে ৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির প্রয়োজন হবে।

অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অনেকটা কমে এসেছে। আর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি থাকার সময়ে দেশের বাজারে সরকার জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে জ্বালানি তেল নিয়ে সরকার কিছুটা হলেও স্বস্তিকর অবস্থানে রয়েছে।

এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছে, তাদের সবকিছু মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে ১৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রয়োজন হবে। অথচ বাজেটে বরাদ্দ আছে ৯ হাজার কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো ভর্তুকি বৃদ্ধির প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে তা চূড়ান্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর এ বিষয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তেলের দাম বাড়ানোর ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। এখন সার এবং বিদ্যুদের দাম বাড়ালে খরচ আরও বাড়বে।

‘সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়লে পণ্যমূল্য আরও বেড়ে যাবে। এর বিরূপ প্রভাব পড়বে জনগণের জীবনযাত্রায়। ফলে পুরো বিষয়টি সমন্বয় প্রশ্নে সরকারের জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।’

অর্থনীতিতে ভর্তুকির বিরূপ প্রভাব তুলে ধরে খ্যাতিমান এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘ভর্তুকি বাড়লে বাজেট বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে ধার নিতে হয়। তখন বাজেট ঘাটতি বেড়ে যায়। ঘাটতি বাড়লে মূল্যস্ফীতিও বাড়ে। এতে করে সাধারণ মানুসের জীবন-যাপন কঠিন হয়ে পড়ে।

‘এসব বিবেচনায় সরকারের সামনে সার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিকল্প কিছু দেখছি না।’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘সরকারের আর্থিক চাপ রয়েছে। কারণ ব্যয় অনুযায়ী আয় বাড়েনি। ভর্তুকির যেসব খাত রয়েছে সেগুলোতে জনগুরুত্ব বিবেচনা করে বরাদ্দ দেয়া উচিত। কৃষি ও বিদ্যুতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি অন্য যেসব খাতে বরাদ্দ আছে সেগুলোতে বরাদ্দে লাগাম টানতে হবে।’

প্রণোদনা খাতে অনেক ব্যয় হয় উল্লেখ করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘সরকার বিভিন্ন খাতে যেসব প্রণোদনা দিচ্ছে, তার একটি মূল্যায়ন হওয়া দরকার।

‘অনেক খাতে প্রণোদনা যে উদ্দেশ্যে দেয়া হয় তা পূরণ হয় না। বেশকিছু বড় প্রকল্পে মূল্য সংযোজন কর- ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ফলে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। এসব খাতে যৌক্তিকতা নির্ধারণ করে প্রণোদনা দিলে অনেক অর্থ সাশ্রয় হতে পারে।

‘শুধু সার ও বিদ্যুতের দাম বাড়ালে যে সরকারের অর্থ সাশ্রয় হবে তা নয়, বরং সামগ্রিকভাবে অন্য বিষয়গুলো‌ও বিবেচনায় নেয়া দরকার।’

এ বিভাগের আরো খবর