জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে টাকা নিয়েছে কিছু তরুণ। পথচারীদের তারা প্রথমে ধরিয়ে দিয়েছে নৌকা প্রতীকের কোট পিন। এরপর কোট পিন বাবদ টাকা চাওয়া হয়েছে।
শুধু বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস নয়, আওয়ামী লীগের বড় কর্মসূচিকে ঘিরে এ ধরনের চাঁদাবাজি কিছু দিন ধরে শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই এলাকায় চলাচলকারী একাধিক ব্যক্তি।
সোমবার সকাল থেকে ধানমন্ডিতে মেট্রো শপিং মলের পাশে ১২ নম্বর সড়কে অবস্থান নেয় কিছু তরুণ। প্রাইভেটকার, রিকশা থামিয়ে তারা নৌকা প্রতীকের কোট পিন গছিয়ে দেয় যাত্রীদের হাতে। এরপর ওই কোটপিনের ব্যয় হিসেবে চাওয়া হয় টাকা।
বেলা ১১টার দিকে এই তরুণদের সামনে পড়েন সঞ্জয় দে নামে এক সংবাদকর্মী। তিনি বলেন, ‘আমাদের গাড়িটি ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়ালে কয়েকজন তরুণ এগিয়ে আসেন। তারা গাড়ির কাচে টোকা দিয়ে আমাকে ও চালককে দুটি কোট পিন দেন। তারা বলেন, আজ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস, এটা নেন। এই দিনে আমাদের সবার রেসপেক্ট দেখানো উচিত...’
কোট পিন নিয়ে গাড়ির কাচ ওঠাতে গেলে তরুণরা ওই সংবাদকর্মীর কাছে টাকা দাবি করেন। ‘খুশি হয়ে’ হয়ে কিছু টাকা দেয়ার আব্দার করেন তারা। ওই সময় সেখানে অন্য আরও কয়েকজন যাত্রীর কাছ থেকে টাকা চাওয়া এবং এ জন্য তরুণদের জোরাজুরি করতে দেখেছেন বলে জানান সঞ্জয় দে।
গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে একই কায়দায় চাঁদাবাজদের খপ্পরে পড়েন রুবায়েত নামের এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘আমাকে এই ১২ নম্বর সড়কেই আওয়ামী লীগের পতাকার কোট পিন দেয় এবং টাকা দাবি করে। তারা দেয়ার সময় মনে হয়, আনন্দে এটি বিতরণ করছে। কিন্তু তাদের আসল চেহারা বেরিয়ে আসে কোট পিনটি নেয়ার পরপরই। দাবি করা হয় টাকা। যার কাছ থেকে যত নিতে পারে।’
রুবায়েত বলেন, ‘তাদের এই টাকা নেয়াটার প্রক্রিয়াটা প্রকাশ্য চাঁদাবাজির মতো। কেউ কিছু বলে না।’
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ উপলক্ষে গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর রাজধানীতে ‘বিজয় শোভাযাত্রা’ করে আওয়ামী লীগ ৷ এই র্যালির দিনও এ ধরনের চাঁদাবাজির শিকার হয়েছেন সাধারণ মানুষ।
একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর সাবেক কান্ট্রি প্রধান আসিফ মুনীর তার ফেসবুক পেজে গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর একটি পোস্ট দেন, যার শিরোনাম ছিল ‘বিজয় র্যালির ঢাকা শহর ও যুব লীগ-এর নামে চাঁদাবাজি !!’
তিনি লিখেছেন, ‘ঢাকা শহরে কোনো বড় আয়োজনের জন্য প্রায়শই যানজট ও রাস্তা বন্ধের সামগ্রিক ও সময়মত সংবাদ পাওয়া যায় না। তাই পথে নেমে জনগণকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বিজয়ের পঞ্চাশতম বছরের উদযাপনেও আজ ও গত কয়েক দিন একই অবস্থা। তার মাঝে আজ আমার হলো এক অযাচিত অভিজ্ঞতা।
‘সেগুনবাগিচার গলিতে আজ ভরদুপুরে হাসিমুখে কয়েকজন তরুণ আমার রিকশা ঘিরে দাঁড়াল। আমার সামনে একটি গাড়িও আটকানো হয়েছিল। এক এক করে তিনটি ব্যাজ পরিয়ে দিতে দিতে তারা বললো, বিজয় র্যালির উৎসবে যুব লীগের কর্মীদের জন্য খুশি হয়ে কিছু টাকা দিতে। কিন্তু প্রায় জোর জবরদস্তি করা হলো আমার সাথে। বলা হলো, কেউ কেউ ১০ হাজার টাকাও দিয়েছে। প্রতিটি ব্যাজের নামে আমার কাছে শেষে দর কষাকষি করে ২ হাজার টাকা করে চাওয়া হলো। আমি যতই বলি আমার পকেটে বেশি টাকা নেই, ছেলে ৩ জনও ততই নাছোড়বান্দা। শেষে দুটো ৫০০ টাকার নোট ও একজনের মাথায় আশীর্বাদ (!!) করে আমি মুক্তি পেলাম। এই অভিজ্ঞতা আমার প্রথম, তবে রিকশা বা সিএনজি অটো থামিয়ে অতীতে আমার কাছ থেকে টাকা-পয়সা ছিনতাই হয়েছে অনেক দিন আগে – সেই ঘটনাই মনে পড়ল।’
এই ঘটনায় আসিফ মুনীর মর্মাহত হয়েছেন বলে তার পোস্টে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেন, ‘বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে এমন ঘটনায় আমি ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবাইকে জানাবো কি জানাবো না, জানালে কোনো বিপদে পড়ি কিনা, লিখলে আদৌ এসব বন্ধ হওয়ার কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে কিনা – এসব ভেবেও লিখলাম। টাইম লাইনে থাকুক, আর কিছুই না হলেও।’
ধানমন্ডি এলাকায় এ ধরনের চাঁদাবাজদের উপস্থিতির বিষয়টি স্বীকার করেছেন থানা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা। তারা বলেন, ধানমন্ডি ৩২ ঘিরে আওয়ামী লীগের বড় কর্মসূচি থাকলে একদল তরুণ কোট পিন দেয়ার নামে জোর করে টাকা আদায় করে। তারা একাধিক অনুষ্ঠানে তাদের সরিয়ে দিয়েছেন।
তবে সোমবার দিনভর চলা এই চাঁদাবাজদের তথ্য পুলিশ জানতে পারেননি বলে জানান ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) ইকরাম আলী মিয়া। তিনি বলেন, ‘এমনটি করার সুযোগ নেই। আজকে ওই এলাকা থেকে আমাদের কাছে এমন কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ পেলেই অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এই বিষয়টি জানা নেই বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, এ ধরনের কাজ কেউ করছে কিনা, তা আমার জানা নেই।’
আওয়ামী লীগ বা তার অঙ্গ সংগঠনের নাম করে কেউ এভাবে জোর করে টাকা আদায় করলে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে – এমন প্রশ্নে বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, ‘আগে আমাকে বিষয়টা জানতে হবে। আমি জেনে নেই।’
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের উপ দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান নিউজবাংলাকে বলেন, এসব বিক্রি করার বিষয়ে দল থেকে কোনো নির্দেশনা নেই।
আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘দল থেকে এমন কোনো নির্দেশনাও নেই। এরা দলেরও কেউ নয়।’