বানর গোত্রীয় (প্রাইমেট) প্রায় সব প্রাণীর রয়েছে লম্বা লেজ, তবে মানুষ এদিক থেকে আলাদা। বিবর্তনীয় ধারায় আমরা মানুষ হয়েছি লেজ হারিয়ে। ‘লেজবিশিষ্ট মানুষ’-এর কথা এখন শুধু টিকে আছে হাস্য-রসিকতায়।
তবে বিবর্তন ভিন্নভাবে হলে কী ঘটত? লেজ ঝুলিয়ে হেঁটে বেড়াতে প্যান্টে বাড়তি একটা ফুটো লাগত, সেটা তো জানা কথাই। তবে মানবশরীরেও দেখা যেত বড় ধরনের পরিবর্তন। শুনতে হাসির মনে হলেও লেজযুক্ত মানুষের হাঁটাচলার ভঙ্গি হতো একদম অন্যরকম।
লেজ খসিয়ে জন্ম মানুষের
লেজ নিয়ে হাসিঠাট্টার অন্ত না থাকলেও মাতৃজঠরে আমাদের সবারই ছিল একেকটা লেজ। জন্মের আগেই অবশ্য সেটি হারিয়ে যায়।
সাধারণত ভ্রূণের ছয় সপ্তাহের দিকে এই ছোট লেজের আবির্ভাব ঘটে। মেরুদণ্ডের বর্ধিত এ অংশে প্রায় এক ডজন ছোট ছোট কশেরুকাও থাকে। তৈরি হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে অবশ্য এর অর্ধেক বিলুপ্ত হয়, আর বাকি অর্ধেকে তৈরি হয় কক্সিস হাড় বা টেইলবোন।
প্রকৃতি সব সময়ই বৈচিত্র্য পছন্দ করে। সে কারণেই বিরল কিছু ক্ষেত্রে ভ্রূণাবস্থার লেজের সম্মুখ অংশটি নিয়েই মানবশিশু জন্ম নেয়। এদের মধ্যে ছেলেশিশুর সংখ্যাই বেশি। তাদের ক্ষেত্রে এই বাড়তি অংশটিতে যথেষ্ট পরিমাণে রক্তনালি থাকে। অনেক সময় এতে পেশিও থাকে। যার সাহায্যে একে হালকা নড়াচড়া করানোও যায়। এ অংশটিতে আসল কশেরুকার কোনো অংশ থাকে না।
এমন লেজবিশিষ্ট শিশু জন্মের সংখ্যা হাতে গোনা। এসব শিশুর জন্মের পরপরই সাধারণত অস্ত্রোপচার করে লেজ ফেলে দেন চিকিৎসকেরা। কারণ ভবিষ্যতে বিড়ম্বনা ঘটানো ছাড়া এই অতি ছোট লেজের আর কোনো উপযোগিতা নেই।
তবে মানুষের পূর্ণাঙ্গ লেজ থাকলে চিকিৎসকেরা নিশ্চয়ই কাউকে অস্ত্রোপচারের টেবিলে তুলতেন না।
মানুষের কেন লেজ নেই?
৬ কোটি ৬০ লাখ বছর আগে উল্কার আঘাতে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ১ কোটি বছরের মধ্যে প্রাইমেটদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবির্ভাব।
আধুনিক ও আদি বানর, লিমার, টারসিয়ার ও বুশ-বেবি গোত্রের প্রাণীর মতো অতি প্রাচীন প্রাইমেটদের লম্বা লেজ ছিল। এই লেজ তাদের গাছের ডাল থেকে ডালে চলাচলের সময় ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করত।
বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় পরে লেজগুলো বাড়তি এক বৃদ্ধাঙ্গুলির ভূমিকায় কাজ করার সক্ষমতা অর্জন করে। কোনো কোনো প্রাণীর ক্ষেত্রে এটা এতটাই কার্যকর হয়ে ওঠে যে প্রাইমেটদের দুটি ধারা তৈরি হয়।
২ কোটি বছর আগে লেজ ছাড়া একদল প্রাইমেটের আবির্ভাব ঘটে। এদের উত্তরসূরির মধ্যে রয়েছে এখনকার গরিলা, শিম্পাঞ্জি, বনোবো, ওরাংওটাং এবং বলাই বাহুল্য মানুষ, মানে আমরা।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে মানুষের মতো কিছু প্রাইমেটের লেজশূন্য হয়ে পড়ার রহস্য। দেখা গেছে, ভ্রাম্যমাণ জেনেটিক কোড এএলইউ বা এলু (আর্থ্রোব্যাকটার লিউটেয়াস)-এর হঠাৎ সংযুক্তির কারণে লেজ তৈরির জন্য দায়ী জিন সক্রিয় হতে পারে না।
নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির স্নাতক শিক্ষার্থী বো শিয়া স্টেম সেল নিয়ে গবেষণার সময়ে এই রহস্য উদ্ঘাটন করেন। ছয়টি লেজহীন বানরবর্গীয় প্রজাতির জিনের সঙ্গে নয় প্রজাতির লেজওয়ালা বানরের জিনের তুলনা করেছিলেন তিনি।
বো শিয়া বিশেষ একটি জিন শনাক্ত করেন যার নাম টি-বক্স ট্র্যান্সক্রিপশন ফ্যাকটর টি (টিবিএক্সটি)। প্রায় ১০০ বছর আগে রাশিয়ান জিনতত্ত্ববিদ নাদেজদা দব্রোভস্কায়া-জাভাদস্কায়ার গবেষণাতেও দেখা গিয়েছিল, এই জিনের রূপান্তরের কারণে খাটো লেজের ইঁদুর জন্ম নেয়।
বিজ্ঞানীরা এখন মোটামুটি নিশ্চিত জিনগত কারণেই বিবর্তিত হয়ে আমরা লেজহীন প্রাণীতে পরিণত হয়েছি।
আমাদের পূর্বপুরুষদের লেজ থাকলে কী হতো?
লেজের অভাবে গাছে ঝুলে থাকার দক্ষতা হারায় আমাদের পূর্বপুরুষরা, তবে যোগ হয়েছে বাড়তি অনেক সুবিধাও।
লেজ শুধু মেরুদণ্ডের শেষ থেকে ঝুলে থাকা বাড়তি অংশই নয়, পশ্চাদ্দেশে লেজের শরীরবৃত্তীয় গঠন অনেক জটিল। এর হাড়, লিগামেন্ট ও পেশি একসঙ্গে দেহকে সারিবদ্ধ রাখে, ভারসাম্য বজায় রাখে এবং কিছু বানরের ক্ষেত্রে কোনো কিছু আঁকড়ে ধরতে সাহায্য করে।
মানুষের এমন লেজ থাকলে তা ব্যবহারের জন্য শক্ত পশ্চাদ্দেশ ও পেশির প্রয়োজন হতো। এটি কিন্তু মোটেই হাসিতে উড়িয়ে দেয়ার মতো সাধারণ শারীরিক গঠন নয়। এক ডাল থেকে অন্য ডালে নির্বিঘ্নে লাফিয়ে যেতে প্রয়োজন লেজের নমনীয়তা। আর সে জন্য লেজওয়ালা প্রাইমেটদের মেরুদণ্ড লম্বা ও কশেরুকার সংখ্যা বেশি থাকে।
অন্যদিকে, লেজওয়ালা প্রাণীর কটিদেশ ছোট থাকে, যা এদের মেরুদণ্ডকে শক্ত করে। শক্ত পিঠের কারণে পতনের ধাক্কা ভালো সামাল দেয়া এবং ইচ্ছেমতো লাফানো সম্ভব।
পুরোনো কিছু হাইপোথিসিস অনুসারে আমরা লেজ হারালেও লেজের পেশিগুলো বাতিল হয়নি। এগুলো আমাদের তলপেটের গুরুত্বপূর্ণ অংশ যেমন মূত্রনালি ও অন্ত্রকে একটি শক্ত কাঠামোতে রাখতে সহায়তা দেয়। এর ফলে আমাদের তলপেট প্রচণ্ড চাপ নিয়ে সব খাবারকে ভেতরে রাখতে পারে। একই সঙ্গে বিষ্ঠা বা মূত্রের বেগ আমরা অনেকটা সময় ধরে রাখতে পারি।
লেজ ব্যবহারের জন্য মস্তিষ্কের বেশ কিছু জায়গা খরচ হতো। পাশাপাশি আমাদের শ্রোণিদেশীয় পেশিকেও বাড়তি কাজ করতে হতো। এটা ঘটলে হার্নিয়া ও মলমূত্র ত্যাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁকি বেড়ে যেত। লেজ থাকলে দুই পায়ে হাঁটার অভ্যাসও গড়ে উঠত না।
মোট কথা আমাদের পূর্বপুরুষরা লেজ না হারালে বিবর্তনের ধারায় হয়তো মানুষেরই আবির্ভাব হতো না।