বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ফুটপাতে বেহাল দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের টাইলস

  •    
  • ৯ জানুয়ারি, ২০২২ ০৯:০৬

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ফুটপাতে হাঁটার জন্য সহায়ক বিশেষ ধরনের টাইলস বসিয়েছে সিটি করপোরেশন। তবে অনেক জায়গায় এগুলোর এখন করুণ দশা। তাছাড়া লোকে ঠিকমতো জানেই না এগুলোর উদ্দেশ্য।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের হাঁটার জন্য ঢাকার ফুটপাতগুলোতে বসানো বিশেষ টাইলস তেমন কাজে লাগে না। ভাঙাচোরা ফুটপাত, হকারের দখল আর নানারকম প্রতিবন্ধকের কারণে এ আয়োজন পণ্ড হয়ে যায়। লোকজনও খুব একটা জানে না, এসব টাইলসের গুরুত্ব কী। তারা এগুলোকে শুধুই নান্দনিক ডিজাইন মনে করে।

নগরের বিভিন্ন সড়কের ফুটপাতে লাল রঙের টাইলসের মাঝে হলুদ রঙের টাইলস বসানো হয়েছে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের হাঁটার সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে। বিশেষ করে প্রধান সড়কের ফুটপাতগুলোয় এটি দেখা যায়।

২০১৫ সালে এই বিশেষ টাইলস ফুটপাতে বসানোর উদ্যোগ নেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। পরে দুই সিটি করপোরেশনই এই টাইলস বসানো শুরু করে। এখনও এ প্রকল্প এখনও চলমান।

হলুদ টাইলসগুলো অমসৃণ, যাতে ঢেউখেলানো উঁচু ধার (রিলিফ) থাকে। এর ফলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরা স্পর্শের অনুভূতির সাহায্য এই টাইলস বরাবর হেঁটে যেতে পারেন। আবার ফুটপাত যেখানে ঢালু, সেখানে টাইলসে ঢেউখেলানো রিলিফের বদলে গোলাকার বৃত্তের রিলিফ রয়েছে। এটি থাকলে একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বুঝতে পারেন, এখানে ফুটপাত নেমে গেছে। এতে তিনি সেখান থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে বা অন্যের সাহায্য নিয়ে গন্তব্য ঠিক করবেন।

রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে দেখা যায়, অনেক জায়গায় ফুটপাতে এই হলুদ টাইলস ভেঙে গেছে। অনেক জায়গায় কোনো টাইলসই নেই। আবার কোথাও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের কথা মাথায় রেখে এখনও টাইলসই বসানো হয়নি।

ফুটপাত দখল করে দোকান বসানো, ফুটপাতে যেখানে-সেখানে বৈদ্যুতিক খুঁটি, টেলিফোনের খুঁটি, গাছসহ অনেক প্রতিবন্ধকতা। তা ছাড়া এ নিয়ে প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা না থাকায় বেশির ভাগ পথচারী জানেন না, ফুটপাতে এই বিশেষ টাইলসের তাৎপর্য কী।

নিউজবাংলার সঙ্গে কথা হয় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সুলতান উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টাইলস বসানোয় আমাদের উপকার হয়েছে। তবে অনেক জায়গায় ফুটপাত ভাঙা, রাস্তায় গাছপালা আর দোকানের দৌরাত্ম্যে ঝামেলা হয়। পরিচিত জায়গার বাইরে গেলে পড়ে যাই, হাত-পা ছিঁড়ে যায়। অনেক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিও এই টাইলসের ব্যবহার জানেন না।’

এই টাইলসের ওপরে ভ্রাম্যমাণ দোকান বসিয়েছেন যেসব হকার, এগুলোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই কোনো।

এ রকমই এক হকারের সঙ্গে কথা হয় রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকার ফুটপাতে। তিনি বলেন, ‘এই টাইলস তো মনে হয় এমনিতেই বসাইছে। কেন বসাইছে জানি না।’

তাকে যখন বলা হয়, তিনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চলাচলের জায়গায় দোকান বসিয়েছেন, তখন তিনি কোনো উত্তর দেননি।

যেভাবে শুরু এই বিশেষ ব্যবস্থার

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠান ভিজুয়ালি ইম্পেয়ার্ড পিপল্‌স সোসাইটির (ভিপস) সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি নিজেও একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি।

নিউজবাংলাকে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এই উদ্যোগটা এসেছিল উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক যখন মেয়র ছিলেন, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। একটি অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে আমরা তাকে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছিলাম। পরে দুই সিটি করপোরেশনেই এই উদ্যোগ নেয়া হয়।

‘আমরা যারা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আছি, তারা রাস্তায় চলার সময় যেন টাইলস ধরে চলতে পারি, এটাই উদ্দেশ্য। প্রথম দিকে সঠিক নিয়ম ধরেই যাত্রাটা শুরু হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে নানা জটিলতা শুরু হয়। অনেক জায়গায় নিয়ম মানে না।’

তিনি বলেন, ‘আমরা ফুটপাতের সাইড দিয়ে যাব, নাকি মাঝ দিয়ে যাব, কোথায় থামব- এ টাইলস আমাদের একটা গাইডলাইন দেবে। মূল কালার থেকে ব্রাইট করে এই টাইলসের রং হলুদ করা হয়। হলুদ টাইলস রাতেও ফুটে ওঠে। এই হলুদ টাইলসে সোজা লাইন। এর মানে সামনে চলো।

‘গোল ডটের টাইলস বসানো হয়েছে থামার জায়গায়। এই টাইলস বিল্ডিংয়ের গেট, বাস স্টপসহ বিভিন্ন থামার জায়গা বোঝায়। এই জায়গায় থেমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমি ডানে নাকি বামে যাব।’

এই টাইলস বসাতেও অনেক জায়গায় ভুল করা হয়েছে উল্লেখ করে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমাদের রাস্তায় মোটরসাইকেলও ফুটপাতে উঠে যায়। তা ছাড়া মানুষ চলতে চলতে ঘষায় ঘষায় বেশির ভাগ জায়গায় হলুদ রং খুঁজে পাওয়া যায় না। সোজা লাইন (রিলিফ) সমান হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় মানুষ নিজেদের মতো করে লাল টাইলস বসিয়েছে। প্রথম দিকে বছরখানেক নিয়মগুলো ভালোভাবেই যাচ্ছিল। এখন ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে যাচ্ছে।’

ফুটপাতের প্রতিবন্ধকতা

ভিজুয়ালি ইম্পেয়ার্ড পিপল্‌স সোসাইটির (ভিপস) সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ড্রেনের ওপর দিয়েই ফুটপাত করেছে। এই ড্রেনের ঢাকনার ওপরে কোনো টাইলস নাই। অনেক জায়গায় ঢাকনা ফাঁকা। অভিযোগ আছে, এই ঢাকনায় ছড়ি ঢুকে গিয়ে ছড়ি ভেঙে গেছে। এই ফাঁকে অনেক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পা ঢুকে গিয়ে স্যান্ডেল ছিঁড়ে যায়। অনেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পান, অনেকে সামনে উঁচু-নিচু দেখে আতঙ্কিত হন।

‘অনেক জায়গায় ড্রেনের ঢাকনার মুখ খোলা থাকে। ময়লা উঠিয়ে পাশে রেখে দিয়েছে। রমনা পার্ক, গুলশান, মহাখালীসহ অনেক জায়গায় দেখেছি প্রতিবন্ধীদের হাঁটার লাইনে গাছ। তার মানে সোজাসুজি গেলে আমার গাছের সঙ্গে বাড়ি খেতে হবে। আবার এই গাছকে এড়িয়ে গেলে আমাকে লাইনচ্যুত হতে হবে।

‘রাস্তায় অনেক জায়গায় মোটরসাইকেল ঠেকানোর জন্য মাঝখানে রড বসিয়ে দিয়েছে। আমরা বারবার বলেছি, এ সব প্রতিবন্ধকতা তুলে দিতে। পুলিশদের আমরা বোঝাতে পারি নাই। আবার পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন যারা করে, তাদের কথা হচ্ছে গাছ কাটা যাবে না। গাছ না কাটলে টাইলস ডানে-বাঁয়ে ঘুরিয়ে দেবেন। ওইটা কিন্তু আর করা হয় নাই। এ ছাড়া শহরের বিভিন্ন জায়গায় টাইলসই বসায়নি।’

প্রচার না থাকায় সঠিক ব্যবহার নেই

টাইলস কেন দেয়া হয়েছে, এটার উদ্দেশ্য কী- এ নিয়ে সিটি করপোরেশনের কোনো প্রচারাভিযান নেই।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এটাকে তারা (সিটি করপোরেশন) পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট হিসেবে নিয়েছে। তবে ক্যাম্পেইন ওভাবে করে নাই। এ ছাড়া হকার বসে হাঁটার জায়গা নষ্ট করে রাখে অথবা দখল করে রাখে। নোংরা কাদা তো আছেই।’

তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন আগে আমার এক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ভাই ফুটপাতে হাঁটতে গিয়ে ফলের ঝুড়িতে পা দিয়েছে। তখন লোকজন তো পারলে তাকে মারে। তার হাঁটার জায়গায় বসে তাকেই মারতে যাচ্ছে।’

কী বলছে সিটি করপোরেশন

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) সেলিম রেজা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘২০১৫ সাল থেকে যতগুলো প্রজেক্ট ঢাকা শহরে আমরা বাস্তবায়ন করি, সবই দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ফুটপাতে বিশেষ ধরনের টাইলস ব্যবহার করেছি। এই কর্মসূচি এখনও চালু। যেখানেই আমরা রাস্তাঘাটে উন্নয়নের কাজ করি, সেখানেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ টাইলস বসানো হয়।

‘যেখানে এগুলো ভেঙে গেছে, সেগুলো সংস্কারের কাজও চলমান। তবে যেখানে রাস্তা ভেঙে ফেলতে হবে বা যেখানে নতুন করে রাস্তা তৈরি করা হবে– সেসব জায়গায় ভাঙা টাইলস এখনও সংস্কার করা হয়নি।’

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য দেয়া বিশেষ টাইলসের লাইনে গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, টেলিফোন বুথ ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতার ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘এখন থেকে এই প্রতিবন্ধকতার যেন সম্মুখীন হতে না হয়, সে নির্দেশনা দেয়া আছে। কোনো ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা থাকবে না। এটা অনেকটা কারেকশানও করে ফেলেছি আমরা।

‘এ ছাড়া গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি আমরা রাস্তা থেকে একটা স্পেশাল অ্যারেজমেন্টে অপসারণ করছি। তবে অনেক প্রাচীন গাছ আসলে কাটা যায় না। গাছ কাটা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এই গাছগুলো রেখে আমরা এমনভাবে নকশা করছি, যাতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অনায়াসে চলতে পারে।’

ফুটপাতে হকারদের দখল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঢাকা শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৯ হাজার মানুষ বসবাস করে। যদি এক-দুই হাজার মানুষ থাকত, তাহলে ঢাকা শহর অন্যরকম হতো। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি যাতে বেদখল না হয় ফুটপাত।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসের বলেন, অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দিকটিও বিবেচনায় রাখা হয়েছে। এ জন্য ৯৬ কিলোমিটারের বেশি ফুটপাতে টাইলস স্থাপন করা হয়েছে। আরও ১১ কিলোমিটার নতুন রাস্তায় এসব টাইলস বসানো হবে। যেসব জায়গায় টাইলস ভেঙে গেছে, সেগুলো নতুন করে ঠিক করা হচ্ছে। ফুটপাতে ড্রেনের ঢাকনা অনেক সময় চুরি হয়ে যায়।’

এ বিভাগের আরো খবর