কক্সবাজারে সম্প্রতি পর্যটকের সংখ্যায় ধস নেমেছে। এর পেছনে নিরাপত্তাহীনতা, খাবারের বেশি দামসহ বিভিন্ন অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।
আকস্মিকভাবে পর্যটকদের সৈকতবিমুখ হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করেছে নিউজবাংলা। এ ক্ষেত্রে কক্সবাজারের পাশাপাশি দেশের দক্ষিণের সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটার দুই সপ্তাহের পরিস্থিতিও যাচাই করা হয়েছে।
দেখা গেছে, কক্সবাজারের মতো কুয়াকাটাতেও দুই সপ্তাহ ধরে পর্যটক-খরা চলছে। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের পর থেকেই মন্দা শুরু হয়। এর জন্য বেশ কয়েকটি কারণ দায়ী বলে মনে করছেন দুটি সৈকতের পর্যটনসংশ্লিষ্টরা।
শীতে পর্যটনের ভরা মৌসুমে গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে ছিল টানা তিন দিনের সরকারি ছুটি। এ সময়ে কক্সবাজারে ঢল নামে পর্যটকের। সে সময় একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, কক্সবাজারে শুধু ডাল-ভাতের দামই ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা রাখা হচ্ছে। আবাসিক হোটেলের চড়া ভাড়া নিয়েও প্রকাশিত হয় বেশ কিছু প্রতিবেদন। এগুলো ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
তবে নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা যায়, হোটেল কক্ষের ভাড়া লাগামহীন হলেও ডাল-ভাতের দাম ৩০০-৪০০ টাকার অভিযোগ ভিত্তিহীন।
আরও পড়ুন: কক্সবাজারে খাবারের দাম আসলে কত?
এরপর ২৩ ডিসেম্বর সৈকত এলাকা থেকে এক ‘পর্যটক দম্পতি’কে অপহরণের পর সন্ত্রাসীরা স্ত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ দেশজুড়ে আলোড়ন তোলে। ধর্ষণের অভিযোগটি তদন্ত করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ।
তবে নিউজবাংলার আরেকটি অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, ধর্ষণের অভিযোগ তোলা নারী পর্যটক হিসেবে সেখানে যাননি। তিনি স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে তিন মাস ধরেই কক্সবাজারে আছেন। ধর্ষণে অভিযুক্তরা তাদের পরিচিত।
আরও পড়ুন: কক্সবাজারে ‘ধর্ষণ’: যৌন ব্যবসার চক্র চালান ভুক্তভোগীর স্বামী
এ দুটি ঘটনার পর পরই কক্সবাজারে পর্যটক-খরা তৈরি হয়েছে। থার্টিফার্স্ট নাইটেও প্রাণহীন ছিল এই পর্যটন নগরী। এর এক সপ্তাহ পর সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও দেখা যায়নি ভ্রমণপিপাসুর চাপ।
সৈকতে গত শুক্রবার যাদের দেখা গেছে তাদের বেশির ভাগই আশপাশের জেলা ও উপজেলা থেকে এসেছেন। শহরের বেশির ভাগ হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টে ভরা মৌসুমেও রয়েছে হতাশা।
আশপাশের জেলা ও উপজেলা থেকে শুক্রবার কক্সবাজারে আসেন অনেকে
ব্যবসায়ীরা বলছেন, থার্টিফার্স্ট নাইটে হোটেল-মোটেলের ৫০ শতাংশের মতো কক্ষ ফাঁকা ছিল। পরের সাপ্তাহিক ছুটিতেও ৮০ শতাংশের মতো রুম ফাঁকা। অথচ স্বাভাবিক চিত্র হলো, বছরের এ সময়ে পর্যটকদের জায়গা দিতে হিমশিম খেতে হয়।
একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে পটুয়াখালীর কুয়াকাটায়। সেখানকার পর্যটন খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার ধাক্কা সামাল দিয়ে এই মৌসুমে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
দুটি সৈকতের ব্যবসায়ী ও পর্যটনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, খাবারের দাম নিয়ে অপপ্রচার ও নারী ধর্ষণের অভিযোগ এবার ব্যবসার ক্ষতি করেছে। তবে এর সঙ্গে থার্টিফার্স্টের আগে লম্বা ছুটি, করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণেও পর্যটকরা সৈকতে ছুটি কাটানোর আগ্রহ হারিয়েছেন।
কক্সবাজারের কলাতলী, সুগন্ধা বা লাবনীতে রয়েছে ৫১৬টি হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট। এসব হোটেলে দেড় লাখের বেশি পর্যটক থাকতে পারেন।
শহরের ব্যবসায়ীরা জানান, অতীতে পর্যটন মৌসুমে (শীতকালে) কক্সবাজারে ১৫ লাখের বেশি পর্যটক এসেছেন। সাপ্তাহিক ছুটি ঘিরে অন্তত দুই লাখ পর্যটকের সামগম থাকত। তবে এবার সেই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না।
‘ভিজতা বে’ রিসোর্টের ব্যবস্থাপক আব্দুল আউয়াল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘থার্টিফার্স্টের আগে ৫০ শতাংশ রুম বুকিং ছিল। গত শুক্রবার তাও হয়নি। উল্টো অনেক বুকিং বাতিল হচ্ছে। বিকাশের একটি দল আসার কথা ছিল। রুমও বুকিং দিয়েছিল তারা। কিন্তু ওমিক্রনের কারণ দেখিয়ে পরে তা বাতিল করা হয়েছে।’সুগন্ধা মোড়ের হোটেল হিল টাওয়ারের ব্যবস্থাপক আব্দুল কাদের নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের হোটেলে শতাধিক কক্ষ আছে। এর মধ্যে গত শুক্রবার ছুটির দিন ঘিরে বুকিং ছিল মাত্র ১২টি, আগে এমন হয়নি।’
তবে সৈকতে কিছুটা পর্যটক ভিড় দেখা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলাতলীর হোটেল আমিন ইন্টারন্যাশনালের মালিক মোহাম্মদ আমিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সৈকতে যাদের দেখা যাচ্ছে তাদের বেশির ভাগই কুমিল্লা, নোয়াখালী বা দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ। এ ছাড়া কক্সবাজারের আশপাশের উপজেলার পর্যটক তো আছেনই। এদের অনেকে দিনে এসে দিনে চলে যান।’
তার কথার সত্যতা মেলে নোয়াখালী থেকে ঘুরতে আসা সাজ্জাদুর রহমানের কথায়। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা প্রায় ৮০ জনের মতো ব্যবসায়ী পিকনিক করতে এসেছি। দুটি বাসে ভোরে রওনা দিয়েছিলাম, পৌঁছেছি ১০টার দিকে। আবার রাতে ফিরে যাব।’
চট্টগ্রাম থেকে পরিবারের ১৪ সদস্য নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন মাওলানা রহিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহর থেকে ভোরে রওনা দিলে ৩ ঘণ্টার মধ্যে কক্সবাজারে পৌঁছানো যায়। সে কারণে হোটেল ভাড়া নিইনি, রাতে আবার ফিরে যাব।’
কলাতলী-মেরিন ড্রাইভ হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘থার্টিফার্স্টের আগে খাবারের দাম নিয়ে অপপ্রচার ও নারীকে ধর্ষণের মামলা আমাদের ব্যবসার ক্ষতি করেছে। সেই ক্ষতি বড় হয়ে উঠছে করোনার নতুন ধরন ঠেকাতে সরকারের নেয়া নানা পদক্ষেপের ঘোষণায়।’
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কক্সবাজারের নিরাপত্তা অনেক ভালো রয়েছে। যে নেতিবাচক প্রভাবের কথা বলা হচ্ছে, তেমন কিছু দেখছি না। তবে করোনার স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে সচেতন করা হচ্ছে।’
কুয়াকাটাতেও হতাশা
কুয়াকাটার ইলিশ পার্ক রিসোর্টের মালিক ইমতিয়াজ তুষার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে টানা ছুটির সময় (বিজয় দিবস ও সাপ্তাহিক ছুটি) পর্যটকের অনেক চাপ ছিল। তখন সব হোটেল-মোটেল হাউসফুল ছিল। মূলত ওই ছুটি কাটিয়ে যাওয়ার কারণেই থার্টিফার্স্ট নাইট এবং জানুয়ারির শুরুর দিকে পর্যটক উপস্থিতি কম।’
পর্যটক উপস্থিতি কমেছে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতেও
কুয়াকাটায় ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে পর্যটক সমাগমের পর ভিত্তিহীন কিছু প্রচার চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন কুয়াকাটার সমুদ্রবাড়ী রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরুল ইসলাম।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই সময়ে প্রচুর মানুষ কুয়াকাটায় আসেন। তখন বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম প্রচার করে কুয়াকাটায় কোনো সিট নেই। এর ফলে অনেকেই থার্টিফার্স্ট উদযাপনে আর কুয়াকাটাকে বেছে নেননি।’
গুজবের অভিযোগের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘কুয়াকাটার সব আবাসিক হোটেলে নভেম্বরে ৫০ শতাংশ ছাড় দেয়া হয়েছিল। তবে ডিসেম্বরে ওই ছাড় বাতিল করা হয়। বিষয়টি না জেনে যারা কুয়াকাটা এসেছিলেন, তাদের অনেকে পরে ফেসবুকে বাড়তি ভাড়া নেয়ার গুজব ছড়ান।’
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আ. মোতালেব নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অনেকের মনের মধ্যে আশঙ্কা, করোনা দিন দিন বাড়ছে। যেকোনো সময় আবার লকডাউন হতে পারে। এ কারণেও অনেকে দূরে কোথাও যাওয়ার চিন্তা করছেন না।’