বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ওয়েবিল: কথা রাখেননি বাস মালিকরা, ঘুমিয়ে বিআরটিএ

  •    
  • ৮ জানুয়ারি, ২০২২ ১৮:১০

গত ১০ নভেম্বর বাস মালিকদের সমিতি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সংবাদ সম্মেলনে এসে বলেন, ঢাকায় কোনো বাস ওয়েবিলে চলবে না। কিন্তু এখনও এই কৌশলে যাত্রীদের কাছ থেকে কোনো কোনো পথে দ্বিগুণ, কোথাও তিন গুণ ভাড়া আদায় চলছে।

অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে কিলোমিটারের বদলে কিছু দূর পরপর একটি নির্ধারিত দূরত্বের হিসাব করে ওয়েবিল নামে কৌশল বন্ধ হয়নি। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির পর বাস ভাড়া বাড়িয়ে দেয়ায় এ বিষয়টি আবার সামনে আসার পর পরিবহন মালিক সমিতি ও সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঘোষণা দিয়েছিল, ঢাকায় কোনো বাস ওয়েবিলে চলবে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, একটি বাসও ওয়েবিল ছাড়া চলছে না। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার দ্বিগুণ, কোথাও কোথাও তিন গুণ আদায় চলছে এই সুযোগে।

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাস ভাড়া হবে কিলোমিটার হিসাবে। প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ঠিক করা হয়েছে ২ টাকা ৫ পয়সা থেকে ২ টাকা ১৫ পয়সা। তবে একজন যেটুকু দূরত্বেই যান না কেন, রাজধানীতে বড় বাসে তাকে ১০ টাকা আর মিনিবাসে দিতে হবে ৮ টাকা।

অর্থাৎ কোনো যাত্রী যদি ৪ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার যান, তাহলে তার কাছ থেকে নেয়া যাবে সর্বোচ্চ ১০ টাকা। এরপর প্রতি কিলোমিটারে যোগ হওয়ার কথা ২ টাকা ১৫ পয়সা।

ঢাকার বাস চলাচলে শৃঙ্খলা আনতে পরীক্ষামূলক চালু হওয়া ঢাকা নগর পরিবহনে এভাবেই ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এই সেবা চালু হওয়ার পর কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর পর্যন্ত রুটটি চালু হওয়ার পর এই পথে চলাচলকারী যাত্রীদের বাস ভাড়া দিতে হচ্ছে কম।

কিন্তু অন্য কোনো রুটে এই ব্যবস্থা নেই। একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর ওয়েবিল বসিয়ে এক ওয়েবিল থেকে পরের ওয়েবিল পর্যন্ত পুরো পথের ভাড়া নেয়া হয় যাত্রীর কাছ থেকে।

যেমন- এয়ারপোর্ট পরিবহনের বাসে করে কেউ যদি কারওয়ান বাজার নামেন, তাহলে তাকে সেখানে থাকা ওয়েবিলের ভাড়া দিতে হয়। কিন্তু ২০০ গজ দূরে বাংলামোটর নামলেই তাকে দিতে হয় গুলিস্তানের ভাড়া।

গাজীপুর থেকে সদরঘাট পর্যন্ত চলা প্রভাতী বনশ্রী পরিবহন ওয়েবিল বসিয়েছে সাতরাস্তা মোড়ের আগে। কেউ যদি মগবাজার নামতে চান, তাহলে সাতরাস্তা ওয়েবিল থেকে সদরঘাট ওয়েবিল পর্যন্ত ভাড়া ২০ টাকার পুরোটাই দিতে হয়। অথচ মগবাজার ওয়্যারলেস থেকেও বাসটি যাত্রী তোলে এবং সদরঘাট পর্যন্ত ভাড়া নেয় ২০ টাকাই।

ঢাকা শহরে নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি ভাড়া আদায়ের নানা কৌশলের মধ্যে ওয়েবিল চালু হতে থাকে ২০১৭ সালে। প্রথমে কয়েকটি রুটে এবং পরে সব কটি রুটেই এভাবে বাড়তি ভাড়া আদায় হতে থাকে।

ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর পর গত ৭ নভেম্বর বাস ভাড়া বাড়ানোর ঘোষণা আসার ফলে ওয়েবিলের নামে যাত্রী ঠকানোর এ বিষয়টি আবার সামনে আসে। দেখা যায়, ভাড়া বাড়িয়ে যত টাকা করা হয়েছে, আগে থেকেই ওয়েবিলের সুযোগে তার চেয়ে বেশি আদায় হচ্ছিল। ভাড়া বাড়ানোর সুযোগ নিয়ে এর পর থেকে আদায় হতে থাকে নির্ধারিত হারের চেয়ে অনেক বেশি।

গত ১০ নভেম্বর বাস মালিকদের সমিতি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সংবাদ সম্মেলনে এসে বলেন, ‘কোনো ধরনের সিটিং সার্ভিস ও ওয়েবিলের মাধ্যমে কোনো বাস চলবে না। আমরা তিন দিন সময় দেব, এরপর কোনো গেটলক ও সিটিং সার্ভিসের বাস চললে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

পরের দিন সড়ক পরিবহন সচিব মো. নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পেলে আপাতত আর্থিক জরিমানা ও বাড়তি ভাড়ার টাকা যাত্রীদের ফেরত দেয়া হচ্ছে। এর পরও বাড়তি ভাড়া নিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘আমরা ওই বাসকে ডাম্প করাসহ রুট পারমিট বাতিল করব।’

তারও দুই দিন আগে গত ৯ নভেম্বর বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহম্মদ মজুমদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিআরটিএ থেকে সিটিং সার্ভিস বা ওয়েবিলের কোনো অনুমতি নেই। এগুলো পুরোই অবৈধ। এসব নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা কাজ করছেন।’

কিন্তু অতীতের নানা ঘোষণার মতো এসব ঘোষণাও ফেলনা হয়ে গেছে। ওয়েবিলের নামে যাত্রীদের পকেট কাটছে বাসগুলো।

ওয়েবিল কী

একটি নির্ধারিত টার্মিনাল বা স্টপেজ থেকে বাস ছাড়ার পর বিভিন্ন পয়েন্টে চেকার থাকেন। যারা ওই পয়েন্ট পর্যন্ত কতজন যাত্রী বাসে রয়েছে তার একটা হিসাব কাগজে লিখে রাখেন। এই কাগজের শিটটি নিয়ে চলেন চালকরা। প্রতিটি পয়েন্টে হিসাবটা লিখে দেন চেকাররা।

ওয়েবিল নামে এই শিটটি থাকলে কত যাত্রী একটি বাসে চলাচল করেছে এবং কত টাকা ভাড়া উঠেছে তার একটি কাছাকাছি হিসাব পাওয়া যায় বলে দাবি মালিকদের।

রাজধানীর বিভিন্ন রুটে নির্ধারিত ভাড়া ও প্রকৃত আদায়ের চিত্র

যেভাবে বাড়তি ভাড়া আদায়

ওয়েবিল কোথায় বসানো হবে, সেটি একান্তই বাস কোম্পানির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। যেমন মোহাম্মদপুর থেকে বনশ্রী হয়ে ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার পর্যন্ত চলা স্বাধীন পরিবহন ফার্মগেট থেকে রামপুরা পর্যন্ত ৬ দশমিক ৩ কিলোমিটার সড়কে তিনটি ওয়েবিল বসিয়ে প্রতি ওয়েবিলের জন্য ১০ টাকা করে ৩০ টাকা আদায় করছে। অথচ এই রুটের ভাড়া হওয়া উচিত ১৩ টাকা।

এই পরিবহনের চেকিং পয়েন্ট রয়েছে খামাড়বাড়ি, মগবাজার, আবুল হোটেল, বনশ্রী ও ডেমরা। এক চেকিং পয়েন্ট থেকে আরেক চেকিং পয়েন্টে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা করে নিচ্ছে তারা। যদিও মিনিবাস হিসেবে এই পরিবহনে সর্বনিম্ন ভাড়া হওয়ার কথা ৮ টাকা।

এই ২ টাকা বাড়তি নেয়ার পাশাপাশি চেকিং পয়েন্ট থেকে কিছু দূর আগের একটি স্টপেজ থেকে যাত্রী উঠলে দূরত্ব যতই হোক, তাকে গুনতে হয় ২০ টাকা।

ওয়েবিল সিস্টেম চালু থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন স্বাধীন পরিবহনের একজন চালক পারভেজ মিয়া। তিনি বলেন, ‘আমাদের সব চালক, হেলপার এক না। মালিক যাতে টাকাটা সঠিকভাবে পান সে জন্য ওয়েবিল।’

মিরপুর-১ থেকে বনশ্রী চলাচলকারী আলিফ পরিবহনের নাজমুল নামে একজন যাত্রী জানান, কাজীপাড়া থেকে গুলশান পর্যন্ত ওয়েবিলে বাড়া ঠিক হয়েছে ২৫ টাকা। মহাখালী নামলেও একই ভাড়া দিতে হয়। অথচ এই পথের দূরত্ব ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। ভাড়া হওয়ার কথা ১০ টাকা।

লাব্বায়েক, প্রভাতী বনশ্রী, তরঙ্গ, ঠিকানা, বিহঙ্গ, রাইদা, শেকড় পরিবহনেও এই ওয়েবিলের নামে বাড়তি ভাড়া নিতে দেখা গেছে।

এসব বাসে বিআরটিএ নির্ধারিত বাস ভাড়ার চার্টগুলো ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে এ নিয়ে ঝগড়া করে স্পষ্টত ক্লান্ত হয়ে গেছেন যাত্রীরা।

রাজধানীর বিভিন্ন রুটে নির্ধারিত ভাড়া ও প্রকৃত আদায়ের চিত্র

ব্যবস্থা নিচ্ছি: এনায়েত উল্যাহ

এই নৈরাজ্য ঠেকাতে কোনো পদক্ষেপ না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ নিউজবালংলাকে বলেন, ‘ওয়েবিলের বন্ধের চেষ্টা করছি। ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’

মালিক সমিতির সিদ্ধান্ত কেন বাস মালিকরা মানছেন না তা জানতে চাইলে কোনো উত্তর দেননি তিনি। ‘একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং’য়ের কথা জানিয়ে তিনি ফোন কেটে দেন।

একই প্রশ্ন রাখা হয় নির্বাহী ম্যাজিস্টেট মো. ফখরুল ইসলামের কাছে। তিনিও দেন গতানুগতিক জবাব। বলেন, ‘আমাদের নিয়মিত অভিযান চলছে। যারা অমান্য করছেন তাদের বিরুদ্ধে প্রতিদিনই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’

তিনি স্বীকার করেন বাড়তি ভাড়া আদায় পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। বলেন, ‘অধিকাংশ বাসে নতুন ভাড়ার তালিকা পাওয়া যায় না। চালক ও কন্ডাক্টরা ছিঁড়ে গেছে, হারিয়ে গেছে এসব অজুহাত দেখায়।’

কিছু বাসের রুট পারমিট বাতিলের উদ্যোগ

সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার নিউজবাংলার কাছে স্বীকার করেন, বাস ভাড়ার বিষয়টি শৃঙ্খলায় ফেরেনি।

তিনি বলেন, ‘তাদের কোনোভাবেই নিয়মের মধ্যে রাখা যাচ্ছে না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে সমাধান হচ্ছে না। আমরা কিছু বাসের রুট পারমিট বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেটাও প্রক্রিয়াধীন।’

বিআরটিএ চেয়ারম্যানের দাবি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ কমছে। তিনি বলেন, ‘নিয়মিতই আমাদের আটটি ভ্রাম্যমাণ আদালত রাজধানীজুড়ে পরিচালিত হচ্ছে। তারা প্রথম দিকে দৈনিক গড়ে ৪০টির মতো বাসে বাড়তি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ পেতেন এবং সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতো। এখন সেটা কমতে কমতে ৯ থেকে ১০টিতে ঠেকেছে।’

এ বিভাগের আরো খবর