দোকানে পাশাপাশি ট্রেতে বাহারি মিষ্টি দেখে জিভে জল আসে। পছন্দেরটা খেতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সে মিষ্টি ভালো নাকি মন্দ, তা চেনার উপায় জানেন না অনেকে। তাদের সহায়তা করতে নিউজবাংলা কথা বলেছে সংশ্লিষ্ট তিনজনের সঙ্গে।
মিষ্টান্ন সম্পৃক্ত তিনজনই জানিয়েছেন, মিষ্টির ভালো-মন্দ অনেকটাই নির্ভর করে তার মূল উপাদান দুধ থেকে তৈরি ছানার ওপর।
তাদের একজন মধুবন সুইটসের রাজধানীর মধ্যবাড্ডা শাখার প্রোডাকশন ম্যানেজার মো. আলমগীর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভালো গাছের জন্য যেমন ভালো বীজ দরকার, তেমনি ভালো মিষ্টির জন্য দরকার ভালো দুধ। ভালো দুধ না দিলে মিষ্টি কখনোই ভালো হবে না।’
তিনি বলেন, ‘ভালো দুধ থেকে যে ছানা হয়, তা জমাট বাঁধা থাকে। অন্যদিকে ভেজাল দেয়া দুধের ছানা হয় ছাড়া ছাড়া।’
রসগোল্লা বা অন্য ধরনের মিষ্টিতে ভেজালের প্রক্রিয়া নিয়ে মধুবনের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘ভালো মিষ্টিতেও ছানার সঙ্গে অল্প পরিমাণ ময়দা মেশানো হতে পারে, তবে ময়দা বেশি দিয়ে অল্প একটু ছানা দিলে মিষ্টি কখনো ভালো হবে না। এর সঙ্গে অনেকে ক্ষতিকর রাসায়নিক হাইড্রোজও মেশায়।’
আলমগীরের উল্লিখিত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘এই যে কথাগুলো বললেন, এগুলো তো মিষ্টির সঙ্গে জড়িতরা জানবে। আমাদের মতো যারা সাধারণ মানুষ তারা ভালো মিষ্টি চিনবে কীভাবে?’
জবাবে তিনি বলেন, ‘দোকানদারকে বলে এক পিস মিষ্টি খেয়ে নেবেন। ভালো মিষ্টিটা মুখে দিলে গলতে সময় নেবে না। খারাপ মিষ্টিটা শক্ত হবে। অন্যরকম একটা গন্ধ আসবে।’
‘অন্যরকম গন্ধ’ বলতে তিনি বুঝিয়েছেন হাইড্রোজ দেয়া মিষ্টিকে।
দামের বিষয়টি দেখেও ভালো মিষ্টি চেনা যায় বলে মনে করেন আলমগীর। তিনি জানান, ঢাকার বাস্তবতায় উপাদান, কারিগরের পারিশ্রমিকসহ অন্য সব খরচ মিলিয়ে এক কেজি মিষ্টি বানাতে ন্যূনতম খরচ ২২০ থেকে ২৩০ টাকা। সে মিষ্টি দোকানে বিক্রি হয় ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায়। এর কমে রাজধানীতে ভালো মিষ্টি পাওয়ার সুযোগ নেই।
মধুবন সুইটসের প্রোডাকশন ম্যানেজার আরও বলেন, ‘দোকানে ভালো একটা মিষ্টির দাম কমপক্ষে ১৫ থেকে ১৬ টাকা। এর কমে এক পিস ভালো মিষ্টি বেচা সম্ভব নয়।’
ঢাকার সাভারভিত্তিক মিষ্টান্ন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান সঙ্গীতা’স ইয়ামি কেক-এর প্রতিষ্ঠাতা সঙ্গীতা ঘোষ সাহা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একটা বিশুদ্ধ মিষ্টি নরমালি দুই থেকে তিন দিন ভালো থাকে সাধারণ তাপমাত্রায়। তারপর এর স্বাদ এবং রং পরিবর্তন হয়।
‘এ কারণে ভালো মিষ্টি কেনার আগে দেখতে হবে দোকানটা রানিং কি না। যে দোকানে দুই-তিন দিনের পুরোনো মাল থাকে না, সেখান থেকে মিষ্টি কেনা নিরাপদ।’
ভালো মিষ্টির আরেকটি বৈশিষ্ট্য জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভালো ছানার মিষ্টিগুলো ওজনে খুবই হালকা হয়ে থাকে। মুখে দিলেই মুখের মধ্যে দুধের একটা স্বাদ আসে এবং ছানার মধ্যে যে একটা ক্রিমি ভাব, সেটা মিষ্টিতে পাওয়া যায়।’
মিষ্টিতে ভেজাল করা নিয়ে সঙ্গীতা বলেন, ‘পাউডার দুধ নিয়ে অনেকে মিষ্টি বানিয়ে থাকে। এ মিষ্টিতে হালকা একটা হাইড্রোজের গন্ধ আসে। দুধের কোনো টেস্ট নেই বললেই চলে।’
ভেজাল-নির্ভেজাল মিষ্টি নিয়ে সিরাজগঞ্জভিত্তিক অনলাইন শপ বাথান ডেইরির উদ্যোক্তা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান পলাশ আগের দুজনের মতো ভালো ছানার ওপর গুরুত্ব দেন।
তিনি বলেন, ‘মিষ্টির স্বাদ ও মান শতভাগ নির্ভর করে মিষ্টি বানানোর প্রধান উপকরণ ছানার ওপর। ছানায় ক্রিমের পরিমাণের ওপর স্বাদে ভিন্নতা দেখা যায়। মিষ্টির কারিগরের দক্ষতাও গুরুত্বপূর্ণ।
‘দুধ থেকে ছানা বের করার সময় দুধের ক্রিম আলাদা না করে যে ছানা বের করা হয়, তাকে ফুল ক্রিম ছানা বা সারান ছানা বলে। সাধারণত ৪০ কেজি দুধ থেকে ৬-৭ কেজি সারান ছানা পাওয়া যায়। এই ক্রিমযুক্ত ছানা দিয়ে সবচেয়ে ভালো মিষ্টি (রসমালাই, সরমালাই, চমচম) বানানো হয়।’
ছানার আরেক ধরন নিয়ে পলাশ বলেন, ‘দুধ থেকে ছানা তৈরির সময় অনেকে দুধের সব অথবা অর্ধেক ক্রিম বের করে রাখে। এগুলোকে ছাটি ছানা বা ক্রিমবিহীন ছানা বলে। ৪০ কেজি দুধ থেকে ৬-৭ কেজি ছাটি ছানা পাওয়া যায়। এখানে কমে যাওয়া ক্রিমের অংশ ময়দা বা আটা দিয়ে পূরণ করা হয়। এই ছাটি ছানা দিয়ে নিম্ন মানের মিষ্টি বানানো হয়। যেমন: কম দামি রসগোল্লা।’
মিষ্টি বানানোর সময়টাও গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বাথান ডেইরির প্রতিষ্ঠাতা বলেন, ‘মিষ্টি তৈরির সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মিষ্টি কম সিদ্ধ হলে এর ভেতরে বড় দানা বা গুটি থাকতে পারে। আবার কখনো পরিমাণমতো আটা না মিশালে মিষ্টি ভেঙে যেতে পারে।
‘যেসব দোকানি নিজেরাই দুধ থেকে ছানা বের করে মিষ্টি তৈরি করে, তারা চাইলে ভালো মানের মিষ্টি বানাতে পারে, কিন্তু যারা অন্যের ছানা কিনে মিষ্টি বানায়, তাদের ছানার মান ততটা ভালো হয় না এবং এর প্রভাব পড়ে মিষ্টির মান ও স্বাদে।’
মিষ্টি দেখে চেনার কোনো উপায় আছে কি না, সে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মিষ্টি দেখে আসলে চেনা যায় না, তবে গরম গরম মিষ্টি অর্থাৎ বানানোর দিনই নিতে পারলে বা কেনার সময় খেয়ে, টেস্ট করে নিলে ঠকার সুযোগ কম থাকে। ভালো মিষ্টি বিক্রি হয়, এমন দোকান পরিচিত থাকলে, সেখান থেকে পণ্যটি কেনা উচিত।’
মিষ্টির স্বাদ ও ঘ্রাণ নিয়ে এ উদ্যোক্তা বলেন, ‘একেক মিষ্টির একেক স্বাদ, তবে যে মিষ্টির ছানাতে ক্রিম বেশি থাকে, সেসব মিষ্টির স্বাদ সবচেয়ে বেশি।
‘গরমের সময় অথবা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে মিষ্টি টক হয়ে যেতে পারে। টেস্ট করে না নিলে দোকানি এসব টক অথবা বাসি মিষ্টি আপনাকে ধরিয়ে দিতে পারে।’