যেসব ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে অবৈধ উপায়ে মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। চাল, আটা, ভোজ্য তেল, ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের ধরতে মাঠে নেমেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিযোগিতা কমিশন।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকার পরও বাজার কেন অস্থিতিশীল, কারা কারাসাজির মাধ্যমে বাজারে অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করছে, তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।
যোগাযোগ করা হলে প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান মফিজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, 'নিত্যপ্রয়োজনীয়সহ বিভিন্ন পণ্য ও সেবার বিষয়ে আমরা পর্যালোচনা করছি, বাজার কেমন তা বোঝার জন্য। বাজার প্রতিযোগিতাবিরোধী কি না, তা বুঝতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
কারা এসব পণ্য আমদানি করছে কিংবা দেশের ভেতরে উৎপাদন করছে, কত দামে বিক্রি হচ্ছে ইত্যাদির তথ্য পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
তদন্ত করে অসামাঞ্জস্য পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, তদন্ত শেষে যদি কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট করে ব্যবসা করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী কিংবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে কমিশন।
কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা তদন্ত করে মামলা করতে পারি।’
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘ধরা যাক, কোনো ওষুধ কোম্পানি একই শ্রেণির ওষুধ বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে। আমরা মূল্য পার্থক্যের কারণ অনুসন্ধান করি। একই সঙ্গে অসাধু উপায়ে বাজারকে প্রভাবিত করা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখি।’
দায়ী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কমিশন আর্থিক জরিমানা এবং ফৌজধারী মামলা, দুইভাবে ব্যবস্থা নিতে পারে।
অপরাধের ধরন দেখে জরিমানা করা হয়। আগের তিন বছরে প্রতিষ্ঠানটি যে পরিমাণ লেনদেন বা পণ্য বিক্রি করেছে, তার ওপর সর্বনিম্ন ১ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ জরিমানার নিয়ম আছে।
মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিযোগিতা কমিশনের আইনে সরাসরি জেল দেয়ার বিধান নেই। শুধু আর্থিক জরিমানা করা যায়। তবে আমাদের আদেশ না মানলে ফৌজধারি মামলার সুযোগ রয়েছে। ফৌজদারি মামলায় জেলের বিধান আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মূল কাজ হচ্ছে বাজারকে প্রতিযোগী করা। সে লক্ষ্য অর্জনে আমরা কাজ করছি।’
তার মতে, বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করতে পারলে সংশ্লিষ্ট পণ্যের দাম ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমে যেতে পারে।
কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, কমিশনকে যে আইনি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তা যথাযথ প্রয়োগ করতে পারলে বাজারে যে সিন্ডিকেট চক্র আছে, তা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে।
প্রতিযোগিতা কমিশন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিন্ডিকেট প্রতিরোধ করতে নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশ কিছু পণ্যের ওপর অনুসন্ধান করছে কমিশন।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভোজ্যতেল, চিনি, চাল, ছোলা, খেজুর, গম, আটা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, শিশুখাদ্য, দুধ, লবণ, মসুর ডাল, আলু ও সাবান। আরও আছে গরুর মাংস, ব্রয়লার মুরগি, ডিম, আমদানীকৃত ফল, প্যাকিং ফুড, তামাকজাত পণ্য, কনডেন্সড মিল্ক, এলপি গ্যাস ও ওষুধ।
এসব পণ্যের আমদানি তথ্য, যেসব দেশ থেকে কেনা হচ্ছে সেখানের বিক্রয়মূল্য, এসব পণ্যের বার্ষিক মোট চাহিদা, কোন কোন কোম্পানি কতটুকু আমদানি এবং বাজার দখল করে আছে, তা সংগ্রহ করা হচ্ছে।
কমিশনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, তথ্য সংগ্রহের পর বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে বাজার কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়া চলছে কি না।
পাশাপাশি নতুন ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা এ খাতে প্রবেশ করতে কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা আছে কি না, সেটিও অনুসন্ধানে তুলে আনা হবে। এরপর নেয়া হবে আইনগত ব্যবস্থা।
কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, দেশে স্বাস্থ্য খাতে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা চলছে। বাজারে অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের মূল্য নেয়া হচ্ছে ইচ্ছামতো। এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের জিম্মি করে অনেক বেশি অর্থ আদায় করা হচ্ছে।
পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালের সিট, কেবিন, আইসিইউ, সিসিইউ, লাইফ সাপোর্ট ব্যয়, হার্টে রিং বসানোর চার্জ ও সিজারিয়ান অপারেশন চার্জে রোগীর অভিভাবকরা দিশেহারা।
এসব চার্জ কীভাবে আদায় করা হচ্ছে, কোনো নীতিমালা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, পরিবহন খাতে যাত্রীবাহী বাস, লঞ্চ ও ভাড়া নিয়ে চলছে নৈরাজ্য। কৃষিপণ্য ও উপকরণের দাম নিয়ে অরাজকতা চলছে। এসব বিষয় অনুসন্ধানে প্রতিযোগিতা কমিশন থেকে ৯টি টিম গঠন করা হয়েছে। প্রতি টিম পাঁচ থেকে ছয়টি পণ্য নিয়ে কাজ করছে।
এসব পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির প্রমাণ পেলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান মফিজুল ইসলাম।