২০০৯ সাল থেকে টানা সরকারে থেকে দেশের জন্য কী কী করেছেন, তার বর্ণনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশবাসী তার প্রতি আস্থা রাখার কারণেই এই অর্জন হয়েছে। ভবিষ্যতেও জনগণ পাশে থাকবে বলে আশার কথা বলেছেন। স্বপ্ন দেখিয়েছেন একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের।
সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে এ কথা বলেন সরকার প্রধান।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জিতে পরের বছরের জানুয়ারির শুরুতে সরকার গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত টানা ক্ষমতায় আওয়ামী লীগই। এর আগে দেশে কোনো সরকার এত বেশি দিন সরকারে থাকেনি।
শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকার গঠন করেন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে ভোটের অষ্টম দিনের মাথায়। শপথ গ্রহণের তৃতীয় বছর পূর্ণ হলো শুক্রবার।
প্রতি বছর সরকার গঠনের বার্ষিকীতে জাতির উদ্দেশে আসেন শেখ হাসিনা। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি।
শুরুতেই দেশবাসীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে খ্রিষ্টীয় নতুন বছর ২০২২-এর শুভেচ্ছা জানান সরকার প্রধান।
তিনি স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা - সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান এবং মুক্তিযুদ্ধের ৩০-লাখ শহিদ এবং ২-লাখ নির্যাতিত মা-বোনের প্রতি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জানান সশ্রদ্ধ সালাম।
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ও গণতন্ত্রের মানসপুত্র হিসেবে পরিচিত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রতিও গভীর শ্রদ্ধা জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী তার শাসনামলে হওয়া উন্নয়নের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘বিগত ১৩ বছরে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। দারিদ্র্য দূরীকরণ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন, মাতৃমৃত্যু-শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার হার বৃদ্ধিসহ নানা আর্থ-সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে আমাদের উপর আস্থা রাখার ফলে।
‘পর পর তিনবার রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ দিয়ে আপনারা উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে সহায়তা করেছেন। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে আমরা একটি কল্যাণকামী, উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি যাতে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলোর কাতারে সামিল হতে পারে।’
‘এজন্য অতীতে যেমন আপনারা আমাদের সঙ্গে ছিলেন, ভবিষ্যতে আমাদের সঙ্গে থাকবেন, এ আশাবাদ ব্যক্ত করছি’- স্পষ্টত আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এক ধরনের বার্তা দিলেন আওয়ামী লীগ প্রধান।
আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন, ‘জনগণের সরকার হিসেবে মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করা আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য বলেই আমি মনে করি। গত ১৩ বছরে আমরা আপনাদের জন্য কী কী করেছি, তা আপনারাই মূল্যায়ন করবেন। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি আমরা যেসব ওয়াদা দিয়েছিলাম, আমরা তা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পেরেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০০৯ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১৩ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আর্থ-সামাজিক এবং অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশ বিস্ময়কর উন্নয়ন সাধন করেছে।
‘২০২১ সাল ছিল আমাদের উন্নয়ন অভিযাত্রার এক অভূতপূর্ব স্বীকৃতির বছর। গত বছর আমরা উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত যোগ্যতা অর্জন করেছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিববর্ষে এই অর্জন বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত আনন্দের এবং গর্বের।’
২০২২ সালে অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাইলফলক হবে বলেও ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী। জানান এই বছরেই চালু হলে পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, বঙ্গবন্ধু টানেল ও রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
এত উন্নয়ন করার পরেও দেশবিরোধী শক্তি ষড়যন্ত্র করছে জানিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান শেখ হাসিনা। বলেন, উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির চেষ্টাও চলছে।
করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন নিয়েও সতর্ক করেন শেখ হাসিনা। সবাইকে টিকা নেয়ার অনুরোধ করেন।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ যে দলেরই হোক আর যত শক্তিশালীই হোক, তাদের ছাড় দেয়া হচ্ছে না এবং হবে না। এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে।’
দুর্নীতিকে একটি ব্যাধি উল্লেখ করে একে দূর করতে সামাজিক সচেতনতা তৈরির কথাও বলেন শেখ হাসিনা।
বলেন, ‘আমরা কঠোর হস্তে জঙ্গিবাদের উত্থানকে প্রতিহত করেছি। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ পারস্পরিক সহনশীলতা বজায় রেখে বসবাস করে আসছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন।’
‘আমাদের পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উদাপনের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে এই উদযাপন কিছুটা সীমিত হলেও মানুষের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার কোন কমতি ছিল না। দেশবাসী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে নতুন করে দেশ গড়ার শপথ নিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল একটি শোষণ-বঞ্চনামুক্ত গণতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের। যেখানে সকল ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশার মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে। প্রতিটি মানুষ অন্ন-বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার সুযোগ পাবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কথা তুলে ধরে জাতির জনকের কন্যা বলেন, ‘তাকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়।
‘তারপর অনেক চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র। সামরিক শাসনের যাতাকলে নিষ্পেষণ, গণতন্ত্রহীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বিচ্যূতি, ইতিহাস বিকৃতিসহ শাসকদের নানা অপকীর্তি প্রত্যক্ষ করেছে এ দেশের মানুষ। জনগণের সম্পদ লুটপাট করে, তাঁদের বঞ্চিত রেখে, ৩০-লাখ শহিদের রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করে বাংলাদেশকে পরনির্ভরশীল করে রেখেছিল।’
১৯৭৫ সালের বিয়োগান্তক ঘটনার পর ৬ বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফেরার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করি। আমার একটাই লক্ষ্য ছিল জাতির পিতার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানো।’
দারিদ্র্য কমবে, বাড়বে কর্মসংস্থান
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উচ্চ মধ্যম-আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের সমৃদ্ধশালী দেশ।’
গত বছর ২০২১-২০২৫ মেয়াদি অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুমোদন হওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এ মেয়াদে ১ কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।’
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শেষে দারিদ্র্যের হার ১৫.৬ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৭.৪ শতাংশে নেমে আসবে বলেও জানান সরকার প্রধান। বলেন, ‘শেষ বছর ২০২৫ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৮.৫১ শতাংশে।’
রূপকল্প ২০৪১-এর কৌশলগত দলিল হিসেবে দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ প্রণয়ন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
করোনার কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। বলেন, ‘দ্য ইকোনমিস্ট ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বলেছে ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৯ম। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।’