ভোট গণনা নিয়ে বিরোধের জেরে বগুড়ার বালিয়াদীঘি ইউনিয়নে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কেন গুলি করতে হলো- এই প্রশ্নে কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা ম্যাজিস্ট্রেটের দাবি, তারা জনগণের জানমাল রক্ষায় বাধ্য হয়ে গুলি করেছেন। তবে ‘জানমাল রক্ষায়’ সেই গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন চারজন।
এই সরকারি কর্মকর্তাদের দাবি, গুলি করা হয়েছিল ফাঁকা, উদ্দেশ্য ছিল কেন্দ্রে ‘হামলাকারীদের’ ভয় দেখানো। তবে সেগুলো গিয়ে বিদ্ধ হয় মানুষের শরীরে।
ভোট শেষে বুধবার বিকেলে ইউনিয়নের কালাইহাটা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে গণনার সময় সংঘর্ষ বাধে। এর আগেও নানা নির্বাচনে এই কেন্দ্রের ভোট গণনা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। আর গুঞ্জন ওঠে কেন্দ্রে গণনা না করে ভোট নিয়ে যাওয়া হচ্ছে উপজেলা পরিষদে। এ নিয়েই গোলযোগের শুরু।
সেই কেন্দ্রে পুলিশের পাশাপাশি মোতায়েন ছিল আধা সামরিক বাহিনী বিজিবিও। সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর গুলিতেই প্রাণহানি হয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
সেই কেন্দ্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শাহজানপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসিফ আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘আমরা কেন্দ্রের ভেতরে ছিলাম। বাইরে স্থানীয় নারী-পুরুষরা লাঠিসোটা নিয়ে কেন্দ্রে হামলা শুরু করে। তারা কেন্দ্রের সামনে থাকা গাড়ি ভাঙচুর করে, কক্ষ লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়ে।
‘এমনকি তারা বিদ্যালয়ের দরজা জানালা ভেঙে ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় তাদের ছোড়া ইটের আঘাতে আমার পা ভেঙে যায়। আমার সঙ্গে থাকা এক আনসার সদস্যরাও আহত হন।’
আসিফ আহমেদ বলেন, ‘ওই সময় উপায় না পেয়ে সরকারি সম্পদ ও জানমাল রক্ষায় আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ভোট কেন্দ্রের ভেতর থেকে গুলি করতে বাধ্য হয়। তবে গুলির উদ্দেশ্য ছিল কাউকে হতাহত করা নয়; গুলির শব্দে যেন বিশৃঙ্খলকারীরা পালিয়ে যায়।’
ইউএনও বলেন, ‘আমরা কালাইহাটা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের ভেতরে ভোট গণনা করছিলাম। কিন্তু ওই ইউনিয়নের কয়েকটি কেন্দ্রে আগে থেকে ঝামেলা করছিলেন স্থানীয় কিছু বিশৃঙ্খল জনতা। তারা হট্টগোল করার পাশাপাশি ইটপাটকেল ছুড়ছিল।’
এই ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী ছিলেন ৯ জন। তারা হলেন জাহিদ হোসেন, মো. আব্দুল মতিন, মো. ইউনুছ আলী মণ্ডল, মো. খাদেমুল ইসলাম, মো. মাহবুবর রহমান, মো. শফিকুল ইসলাম, মো. শাকিউল ইসলাম, মো. শাহিন ফেরদৌস, মো. হাবিবুর রহমান।
ইউনিয়নের মোট ভোটার সংখ্যা ২০ হাজার ২৮৭ এবং কেন্দ্র ৯টি।
তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন নৌকা প্রতীকের ইউনুছ আলী মণ্ডল এবং ঘোড়া প্রতীকের মো. মাহবুবর রহমান। এর মধ্যে ইউনুছ আলী পান ৬ হাজার ৫৬০টি ভোট। আর মাহবুবর রহমান ভোট পান ৪ হাজার ৬৪৯টি।
মাহবুব বিএনপির রাজনীতি করেন। তিনি এর আগে টানা দুইবার এই ইউনিয়নে চেয়ারম্যান ছিলেন।
মাহবুব রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বালিয়াদীঘিতে ৯টি কেন্দ্র রয়েছে। এর আগের নির্বাচনগুলোয় ইউনুছ আলী বিজয়ী হতে পারেননি। শুধু নিজের গ্রাম কালাইহাটার ওই ২টি কেন্দ্র ছাড়া, তাও সম্ভব হয়েছে জোরজবরদখল করে ভোটে সিল মারার কারণে।’
সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, ‘ইউনুছ আলীর মূল দাবি ছিল, তার নাম বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা। স্থানীয়দের উসকে দিয়েছেন তিনি।’
গ্রাম পুলিশের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে জানান, কেন্দ্রের সামনে নৌকার একটি দল মিছিল করছিল আর স্লোগান দিচ্ছিল। এরপর সেখান থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরা তাদের সরানো চেষ্টা করলে তার মারমুখী হয়ে ওঠে। তারপর গুলি করা হয়।
গুলির পর গ্রাম পুলিশের এই সদস্যও ঘটনাস্থল থেকে সরে আসেন।
ইউএনও আসিফ আহমেদ বলেন, ‘স্থানীয়রা এই কেন্দ্রে ভোট গণনা করার বিপক্ষে ছিল। তাদের দাবি ছিল এর আগে নৌকার প্রার্থী তিনবার নির্বাচনে হেরেছেন। এবার যে করেই হোক তিনি জিততে চাইছেন। এ কারণে তারাই দাবি তুলেছিল ভোট উপজেলায় নিয়ে গুনতে হবে।
‘স্থানীয়দের কালাইহাটা কেন্দ্রে ভোট গণনার বিষয়ে একাধিকবার বোঝানোর চেষ্টা করা হয়। তারা শান্তও হয়েছিল, কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরে আবার উত্তেজিত হয়ে নারীদের নিয়ে স্থানীয়রা কেন্দ্রে আসে। তাদেরও নানাভাবে বোঝানো হয় যে আইন অনুযায়ী কেন্দ্রেই ভোট গণনা করার নিয়ম। আমরা তাই করব। কেন্দ্রে ভোট সুষ্ঠুভাবে গণনা করে ফলাফল এখানে (কেন্দ্র) প্রকাশ করা হবে।’
বালিয়াদীঘির কালাইহাটার সাবেক সদস্য বাবলু জানান, ‘ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে সব লোকজনকে ডেকে এই কেন্দ্রেই ভোট গণনা করে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা কথা জানান। কিন্তু নৌকা প্রার্থীর লোকজনেরা তা মানতে চাননি।
‘পরে ম্যাজিস্ট্রেট ব্যালট বাক্স নিয়ে সদরে যেতে চাইলে স্থানীয়রা আবার উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তারা ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। গাড়ি ভাঙে। তারা রাস্তা আটকে রেখেছিল। ওই সময় গুলি করে।’
নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ইউনুছ আলী মণ্ডল অবশ্য জানিয়েছেন ভিন্ন কথা।
তিনি বলেন, ‘ভোটগ্রহণ শেষে ব্যালট পেপার কেন্দ্রে গণনা না করেই উপজেলা পরিষদে নিয়ে যেতে ধরেন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট আসিফ আহম্মেদ। ওই সময় আমার কর্মী-সমর্থকরা কেন্দ্রেই ভোট গণনা করতে বলেন। এর পরেও ম্যাজিস্ট্রেট আসিফ আহমেদ ব্যালট উপজেলা পরিষদে নিয়ে যেতে ধরেন।
‘এ সময় আমার কর্মী-সমর্থকরা বাধা দিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গুলি করেন। তাদের গুলিতে চারজন মারা যান। ওই চারজনই আমার কর্মী-সমর্থক ছিলেন।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে যারা মারা গেছেন তারা হলেন, কুলসুম আক্তার, আলমগীর হোসেন, খোরশেদ ও আব্দুর রশিদ। চারজনই কালাইহাটা গ্রামের বাসিন্দা।
গাবতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়া লতিফুল ইসলাম জানান, বুধবারের সংঘর্ষে নিহত চারজনের মরদেহ বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য নেয়া হয়েছে। এর পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী জানান, এই ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলী হায়দার চৌধুরীকে।
তিনি বলেন, ‘এই কমিটি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি যাচাই-বাছাই করবেন। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেয়া পদক্ষেপের (গুলি চালানোর) যৌক্তিকতা, ক্ষয়ক্ষতি বা পরবর্তী কী পদক্ষেপ নেয়া যায় তা জানাবে।’
মামলা
ভোটকেন্দ্রে হামলা, ভাঙচুর, ব্যালট পেপার ছিনতাই ও সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। এতে ৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি।
গাবতলী থানায় বৃহস্পতিবার দুপুরে এই মামলা করেন বালিয়াদিঘীর কালাইহাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা জাকির হোসেন।
গাবতলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়া লতিফুল ইসলাম বৃহস্পতিবার রাতে মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।