এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণ নিয়ে পোশাকশিল্পের মালিকরা মোটেই উদ্বিগ্ন নয় বলে জানিয়েছেন এ খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।
তিনি বলেছেন, ‘এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের বের হয়ে যাওয়া নিয়ে আমরা মোটেই উদ্বিগ্ন নই। কারণ এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য ইতোমধ্যে বিজিএমইএ সরকার ও ক্রেতা দেশগুলোর সঙ্গে কাজ শুরু করেছে। দক্ষতা উন্নয়ন, বিনিয়োগ বাড়ানো, পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ফলে কোটা ও শুল্কমুক্ত সুবিধাহীন বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের টিকে থাকা নিয়ে আপাতত কোনো সংশয় দেখা যাচ্ছে না।’
বুধবার অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত সংলাপে তিনি এ কথা বলেন।
রাজধানীর পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে আয়োজিত সংলাপটি পরিচালনা করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম। এ সময় সংগঠনের সহসভাপতি ও বার্তা সংস্থা এএফপির ব্যুরো চিফ শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
ফারুক হাসান বলেন, ‘বর্তমানে তাদের কৌশল হচ্ছে এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতিকাল অর্থাৎ ২০২৬ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারের সুবিধা নেয়া। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ২০২৬ সালের পরে যে বাড়তি তিন বছর শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধায় রপ্তানির সুযোগ দেবে, আলোচনার মাধ্যমে তা বাড়ানো। বিজিএমইএ ইইউর কাছে ১০ বছরের জন্য এই সুবিধা চেয়েছে। এরপরে বিজিএমইএ ইইউর সঙ্গে জিএসপি প্লাস নিয়ে আলোচনা করবে। তবে পোশাকমালিকরা চান এই সময়ের মধ্যে সরকার অন্যান্য দেশের সঙ্গে মুক্ত ও অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি করবে।’
তিনি বলেন, ‘বিজিএমইএ সব সময় পুরো খাতের উন্নয়নে কাজ করেছে, এখনও করে চলেছে। এই সংগঠনটিতে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা সকলেই পোশাক শিল্পের উন্নয়নে অবদান রেখেছেন। আমিও উত্তরসূরিদের মতো করে চেষ্টা করে যাচ্ছি ।‘
‘করোনার প্রভাব মোকাবিলায় পোশাক খাতের এসএমই প্রতিষ্ঠানকে সহযোগিতা করতে বিভিন্ন ধরনের চার্জ ও ফিস কমানো হয়েছে। আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাজার ও পণ্য বহুমুখীকরণের কাজ চলছে। কৃত্রিম তন্তুর পোশাক যাতে দেশে বেশি তৈরি হয় সে জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য গবেষণা জোরদার করা হয়েছে।’
বিজিএমইএ সভাপতির সূচনা বক্তব্যের পর উপস্থিত সাংবাদিকরা তার কাছে এ খাতের সমস্যা, সম্ভাবনা, করোনা মহামারি এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন।যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপিবিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে ফারুক হাসান বলেন, ‘বৃহত্তম এই বাজারে তৈরি পোশাক জিএসপি সুবিধা পেত না। এখনও পাচ্ছে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র যে সব শর্ত দিয়েছিল সেগুলো পোশাকমালিকরা ও সরকার বাস্তবায়ন করেছে। কমপ্লায়েন্স বা নিরাপদ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করতে এ দেশের উদ্যোক্তারা প্রচুর বিনিয়োগ করেছেন। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ কারখানা এখন বাংলাদেশে। ১৫৩টি গ্রিন ফ্যাক্টরি রয়েছে দেশে। অর্থাৎ ব্যবসায়ীরা তাদের কাজটি করেছেন। এখন জিএসপি দেয়া না দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়।’
‘দেশটির জিএসপি সুবিধা দেয়ার সঙ্গে শুধু শর্ত বাস্তবায়ন নয়, রাজনীতিও জড়িত। তবে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে। আগামীতে আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। ’বাংলাদেশের র্যাব ও সংস্থাটির কিছু কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব ব্যবসায় পড়বে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ব্যবসায়ীরা চিন্তিত। তবে ব্যবসায়ীদের কাজ তারা করছেন। আমরা কোনো বাজার হারাতে চাই না।’মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের শীতল সম্পর্ক, র্যাব ও সংস্থাটির কয়েকজন কর্মকর্তার প্রতি আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা, আগামী বছরের শেষে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অপর এক প্রশ্নের জবাবে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘আগামী নির্বাচন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসায়ী হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রত্যাশা যে কারখানায় উৎপাদন ও পণ্যের সরবরাহ ব্যাহত হয়, এমন কোনো কর্মসূচি যাতে তারা না দেয়। সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে সেই পরিবেশ থাকতে হবে।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না ব্যবসা করতে গেলে রাজনৈতিক আশীর্বাদ লাগে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্স ২০ থেকে ৩০ বছর আগে নেয়া। তিন দশক আগে বাংলাদেশ যে ধরনের পণ্য তৈরি করত, এখন তার চেয়ে ভিন্ন ও উন্নত পণ্য তৈরি করছে। ফলে পুরোনো বন্ড লাইসেন্সে অনেক পণ্যেরই উল্লেখ নেই, কিন্তু ওই লাইসেন্সধারী কারখানার নতুন পণ্যের প্রয়োজন হচ্ছে। তিনি বলেন, লাইসেন্সে উল্লেখ না থাকলেও ব্যবহারিক ঘোষণাপত্রে(ইউডি) তা থাকছে। কিন্তু কাস্টমস কর্তৃপক্ষ অনেক সময় পণ্য ছাড় করছে না। এতে ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’
এ নিয়ে আগামী সপ্তাহে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে বৈঠক করা হবে বলে জানিয়ে ফারুক হাসান বলেন, ‘অনেকে অভিযোগ করেন যে ব্যবসায়ীরা নতুন বাজার, পণ্য, ডিজাইনে যাচ্ছেন না। কিন্তু যাওয়ার সুযোগ কোথায়। কাস্টমসের জটিলতার মতো অনেক জটিলতার পেছনে ব্যবসায়ীদের দৌড়াতে হয়। ফলে এ ধরনের বিধিবিধান সহজ করে দিলে ব্যবসা সহজ হবে।’
করোনার প্রভাব মোকাবিলার প্রণোদনার ঋণ পরিশোধ প্রসঙ্গে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ‘অনেক কারখানা ইতোমধ্যে ঋণের কিস্তি দেয়া শুরু করেছে। আর কিছু প্রতিষ্ঠান পারছে না। কারণ ওইসব প্রতিষ্ঠানের ক্রেতারা মূল্য পরিশোধ করেনি। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ বিবেচনায় সময় দেয়া উচিত।’
সাম্প্রতিক সময়ের রপ্তানি বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রথমত বেড়েছে রপ্তানি মূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে। এ ছাড়া করোনার সময়ে ক্রেতাদের অনেক দাবি দেশের রপ্তানিকারকরা রেখেছেন। বিশেষ করে পরে ডেলিভারি, দেরিতে মূল্য পরিশোধ, ডিসকাউন্ট ইত্যাদি সুবিধা দেয়া হয়েছে। যে কারণে ক্রেতাদের সঙ্গে রপ্তানিকারকদের একটি সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ফলে এখন ক্রেতারা তাদের বাড়তি চাহিদার পণ্য বাংলাদেশ থেকেই নিচ্ছেন। এ ছাড়া করোনার কারণে মানুষের ভ্রমণসহ অন্যান্য ব্যয় কমেছে। ফলে পশ্চিমারা তাদের অন্য খাতের অর্থ পোশাক কেনায় ব্যয় করছে। পোশাকের সামগ্রিকভাবে মূল্য সামান্য বাড়লেও কাটিং ও মেকিং চার্জ বাড়েনি।’‘আগামী তিন মাসের মধ্যে প্রকৃত পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ও শ্রমিকের সংখ্যা প্রকাশ করা হবে’ জানিয়ে ফারুক হাসান বলেন, ‘সাব-কন্ট্রাক্টের বিষয়ে বিজিএমইএ শক্ত অবস্থানে রয়েছে। আগামীতেও থাকবে। তাজরীন ফ্যাশনের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি তারা চান না। অবশ্যই সাব-কন্ট্রাক্ট হবে, তবে তা একই ক্রেতার পণ্য উৎপাদন করে এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এবং ক্রেতার সম্মতি সাপেক্ষে।’