ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পঞ্চম ধাপে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নের কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে সারা দিনে একজন নারী ভোটারকে কেন্দ্রে পাওয়া গেছে।
ভোটের দিন সকাল থেকেই কয়েকটি কেন্দ্রে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছে নিউজবাংলার প্রতিনিধি। বুধবার বেলা ১১টার দিকে গৃদকালিন্দিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে এক নারী আসেন ভোট দিতে। তিনিই এই কেন্দ্রের একমাত্র নারী ভোটার।
মনোয়ারা বেগম মুন্নি নামের এই ভোটারের বাড়ি রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাহেবগঞ্জ গ্রামে। বিয়ের পর থেকে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থাকেন। ভোট দেয়ার জন্য বাবার বাড়ি এসেছেন।
৩৮ বছর বয়সী মুন্নি জাতীয় পরিচয়পত্র পেয়েছেন ১৬ বছর আগে। তবে ভোট দিলেন এবারই প্রথম।
ভোট দিয়ে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমবারের মতো ভোট দিতে পেরে আমি অনেক উচ্ছ্বসিত। নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছি। আশা করছি, তারা জয়ী হবেন।
‘পিরের কথার কারণে এতদিন আমার বাড়ির কেউ ভোট দেয়নি। আমিও আসলে এ কারণেই ভোট দিতে আসতাম না। এবার আমার স্বামী আমাকে অনেক উদ্বুদ্ধ করেছেন ভোট দিতে। তাই এসেছি। এখন থেকে প্রতি নির্বাচনে ভোট দেব।’
মুন্নি আরও বলেন, ‘পির সাহেব আসলে নারীদের ভোট দিতে মানা করেননি। তিনি পর্দার সঙ্গে চলতে বলেছেন। ভোট দিলে যদি পর্দা নষ্ট হয় তাহলে এই ইউনিয়নের নারীরা বের হয় কেন?
‘আমি মনে করি ভোট দেয়া আমাদের অধিকার। সব নারীর ভোট দিতে কেন্দ্রে আসা উচিত। তবে আমাদের গ্রামের পুরুষরা নারীদের ভোট দিতে উৎসাহ না দিয়ে নিরুৎসাহিত করে আসছে। তাই অনেক নারী ইচ্ছা থাকলেও ভোট দিতে আসেন না।’
এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আয়াছ গাজী বলেন, ‘আমার কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ৩২৪। তাদের মধ্যে নারী ১ হাজার ১৫৪ জন। এখন পর্যন্ত ওই নারী ছাড়া আর কেউ ভোট দেননি। পুরুষরা ভোট দিয়েছেন ৭৭০ জন।’
এই ইউনিয়নের নারীদের ভোট না দেয়ার পেছনের কারণ হিসেবে আছে এক ‘পিরের আদেশ।’
স্থানীয়রা জানান, প্রায় পাঁচ দশক আগে রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নে কলেরা মহামারি ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামবাসীর আয়োজন করা দোয়া মাহফিলে পির মওদুদ হাসান জৈনপুরী আদেশ দেন, ইউনিয়নের সব নারীকে কঠোর পর্দা করতে হবে। আর তাহলেই দূর হবে কলেরা।
এরপর ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। পর্দার কঠোর নিয়ম ধীরে ধীরে শিথিল হলেও ইউনিয়নের নারীরা ভোটকেন্দ্রমুখী হননি। ভোট না দিলেও বাড়ির বাইরের বাকি সব কাজই করছেন নারীরা। এমনকি নির্বাচনেও প্রার্থী হচ্ছেন।
নারীদের কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করতে শনিবার দুপুরে রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নের গৃদকালিন্দিয়া হাজেরা হাসমত কলেজ মিলনায়তনে সভাও করেছে উপজেলা প্রশাসন।
সভায় কোরআন ও হাদিসের আলোকে নারীদের ভোট দেয়ার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন ফরিদগঞ্জ উপজেলা কমপ্লেক্স জামে মসজিদের খতিব মাওলানা ইউনুস হোসেন।
নারীদের উদ্বুদ্ধ করতে আয়োজিত সভায় শনিবার জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, ‘আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, কোনো আলেম নারীদের ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দেবেন না। পর্দা রক্ষা করে নারীদের ভোট দেয়া ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।
‘নারীরা ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকলে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে। অযোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হলে ধর্মীয়ভাবে নারীরাও এর দায় এড়াতে পারেন না। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে তাদের ভোট দিতে হবে।’
বুধবার ভোটের এ চিত্র দেখে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এই ইউনিয়নের দীর্ঘদিনের যে কুসংস্কার রয়েছে তা সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দূর করতে হবে। যুগের পর যুগ প্রচলিত কুসংস্কার এক দিনে তো যাবার নয়।
‘যারা প্রার্থী রয়েছেন সবার উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে নারী ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।’