করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের ছড়িয়ে পড়া রোধে সরকার রাজনৈতিকসহ যেকোনো সমাবেশকে নিরুৎসাহিত করেছে। এর বাইরে বাড়ির বাইরে গেলেই মাস্ক পরা, গণপরিবহন, খাবার দোকান, বিনোদনকেন্দ্র ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ধারণক্ষমতার অর্ধেক মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
এই নির্দেশনাগুলো অবশ্য নতুন নয়, গত ১৯ নভেম্বরই জারি করা হয়েছিল। দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ আবার বেড়ে চলার পরিপ্রেক্ষিতে সেগুলোই নতুন করে জারি করা হলো দেড় মাস পর মঙ্গলবার।
সন্ধ্যার পর তথ্য অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের এই ধরন ডেল্টার চেয়েও বেশি সংক্রামক বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত প্রকাশ করেছেন। তাই এই ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নির্দেশনা বলা হলেও এগুলোতে যে বাধ্যবাধকতা আরোপ হতে যাচ্ছে, সেটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক পদে আহমেদুল কবিরের বক্তব্যে স্পষ্ট।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এই নির্দেশনা যদি কেউ না মানে, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘গতকাল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য যদি শুনে থাকেন, তাহলে অবশ্যই জানবেন সেখানে মোবাইল কোর্ট থেকে শুরু করে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। যারা এই নির্দেশনা অমান্য করবে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলাচলের বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পরিবহন-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে।
আহমেদুল কবির বলেন, ‘গতকাল স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সকল মন্ত্রীর সঙ্গে সচিবালয় বৈঠক করে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র নাজমুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নতুন করে আমরা কোনো নির্দেশনা দিইনি। পিআইডি হয়নি, ভুলক্রমে আগের নির্দেশনা দিতে পারে।’
এ বিষয়ে চানতে চাইলে প্রধান তথ্য কর্মকর্তা মো. শাহেনুর মিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটি প্রচারের কোনো নির্দেশনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেয়নি এটা ঠিক। আমরা এখানে কোথাও তাদের কথা বলিওনি। মূলত গতকাল ওমিক্রন ঠেকাতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যে প্রস্তুতি সভাটি হয়েছে, সেখান থেকে যে নির্দেশনাগুলো এসেছে, সেগুলোই এখানে দেয়া হয়েছে যাতে করে মানুষকে ওমিক্রন নিয়ে সচেতন করা যায়।
‘এখানে নতুন কিছু নেই। আগের নির্দেশগুলোই মানুষকে আবার স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য আইইডিসিআর-এর পক্ষে আমরা এটা প্রচার করেছি। করোনা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি মানার যে বিষয়গুলো রয়েছে, সেগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়াই এটার উদ্দেশ্য।’
দেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও প্রতিবেশী দেশ ভারতের পরিস্থিতি ক্রমেই উদ্বেগজনক হচ্ছে। বাংলাদেশ লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গে এরই মধ্যে স্কুল বন্ধ করে দিয়ে রাতে কারফিউ জারি করা হয়েছে।
সোমবার বাংলাদেশে এক আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক হয় পরিস্থিতি নিয়ে। বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। জানানো হয়, রোগী বাড়লেও স্কুল-কলেজ বন্ধ হবে না, লকডাউনের চিন্তাও নেই আপাতত।
তবে পরদিন সচিবালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন উল্টো কথা। জানিয়েছেন, লকডাউনের বিষয়টি তাদের চিন্তায় রয়েছে। তিনি জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হার আবার বেড়ে যাওয়ায় মানুষের চলাফেরায় আবার বিধিনিষেধ আরোপ করতে যাচ্ছে সরকার।
গত কয়েক দিন ধরেই করোনার সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী। গত ২৪ ঘণ্টায় ৬ জনের মৃত্যুর পাশাপাশি সংক্রমণ ধরা পড়েছে ৭৭১ জনের মধ্যে। রোগীর এই সংখ্যা গত ৪ অক্টোবরের পর সর্বোচ্চ।
কিছুদিন আগেও দেশে ২৪ ঘণ্টায় রোগী শনাক্ত ২০০-এর কোঠায় ছিল।
করোনা পজিটিভ হিসেবে শনাক্তের পাশাপাশি পরীক্ষার বিপরীতে রোগীর হারও বেশি পাওয়া যাচ্ছে। দুই সপ্তাহ আগেও যা দুইয়ের নিচে ছিল, এখন তা চার ছুঁইছুঁই। নির্দেশনা জারির দিন পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার পাওয়া গেছে ৩.৯১।
শনাক্তের এই হার গত ২৯ সেপ্টেম্বরের পর সর্বোচ্চ। সেদিন এটি ছিল ৪.১২ শতাংশ।
পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্ত ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে এবং পরপর দুই সপ্তাহ এই ঘটনাটি ঘটলে দেশে তৃতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে বলে ধরে নিতে হবে। এই মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে বিশ্বব্যাংক।
গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি করোনার প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু এই পরিস্থিতি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। মার্চেই দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতের বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যায়।
এরপর করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসে ৪ অক্টোবর।
যা যা আছে নির্দেশনায়
নির্দেশনার প্রথমেই বলা হয়েছে, যেসব দেশে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে, সেসব দেশ থেকে আসা যাত্রীদের বন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্ক্রিনিং জোরদার করতে হবে।
নির্দেশনায় যেকোনো সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অন্যান্য জনসমাগম নিরুৎসাহিত করতে বলা হয়েছে।
এ ছাড়া
# প্রয়োজনে বাইরে গেলে প্রত্যেককে সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে;
# রেস্তোরাঁ খোলা থাকবে। তবে তাতে আসনসংখ্যা অর্ধেক বা তার চেয়ে কম করতে হবে;
# পর্যটন স্থান, বিনোদনকেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার, সিনেমা হল বা থিয়েটার হল খোলা থাকবে। বিয়ে, বউভাত, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি সামাজিক অনুষ্ঠানও করা যাবে। সেখানেও ধারণক্ষমতার অর্ধেক বা তার কমসংখ্যক লোক অংশগ্রহণ করতে পারবে;
# মসজিদসহ সব উপাসনালয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে;
# গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে;
২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণ হওয়ার পর সাধারণ ছুটি শেষে দুইবার গণপরিবহনে যাত্রী অর্ধেক করা হয়েছে। দুই ক্ষেত্রেই বাস ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এবার এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি নির্দেশনায়।
# আক্রান্ত দেশগুলো থেকে আগত যাত্রীদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে হবে;
# মাদ্রাসা, প্রাক্-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার খোলা থাকবে বলে জানানো হয়েছে। তবে সেগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে;
# সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সেবাগ্রহীতা, সেবা প্রদানকারী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সঠিকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে;
# স্বাস্থ্যবিধি মেনে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে;
# করোনার উপসর্গ বা লক্ষণযুক্ত সন্দেহজনক ও নিশ্চিত করোনা রোগীর আইসোলেশন ও করোনা পজেটিভ রোগীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা অন্যদের কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে;
# করোনার লক্ষণযুক্ত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে রাখা এবং তার নমুনা পরীক্ষার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করে সহায়তা করতে হবে;
# অফিসে প্রবেশ ও অবস্থানকালে বাধ্যতামূলকভাবে নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা দাপ্তরিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে;
সবশেষে করোনা নিয়ন্ত্রণ ও কমানোর জন্য কমিউনিটি পর্যায়ে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সচেতনতা তৈরির জন্য মাইকিং ও প্রচার চালানোর কথাও বলা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডার মাইক ব্যবহার এবং এতে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যসহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।