বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

রপ্তানির রমরমায় ব্যতিক্রম শুধু পাট

  •    
  • ৪ জানুয়ারি, ২০২২ ০৯:৪৯

গত ছয় মাসে তৈরি পোশাক থেকে শুরু করে চামড়া ও ওষুধ পর্যন্ত সব বড় খাতেই রপ্তানি অভাবনীয় বেড়েছে। এই স্রোতে উল্টো হাওয়ায় চলেছে পাট খাত।

করোনা মহামারির মধ্যেও রপ্তানি বাণিজ্যে সুবাতাস বইছে। একের পর এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে সবাইকে অবাক করে দিচ্ছেন রপ্তানিকারকরা।

অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে সদ্যসমাপ্ত ডিসেম্বরে রপ্তানি আয় গিয়ে ঠেকেছে প্রায় ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলারে। বর্তমান বিনিময় হারে (৮৫ টাকা ৮০ পয়সা) টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে বেশি এসেছে ২৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে এত বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে আসেনি। এর আগে একক মাসে সর্বোচ্চ আয় এসেছিল গত অক্টোবরে, ৪৭২ কোটি ৭৫ লাখ ডলার।

আর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) হিসাবে ২৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন (২ হাজার ৪৬৯ কোটি ৮৫ কোটি) ডলার রপ্তানি আয় দেশে এসেছে।

এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৮ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেশি এসেছে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

এই উল্লম্ফনে কেমল রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক, চামড়া, হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত মাছ, কৃষিপণ্যসহ প্রায় সব খাতেই অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। ব্যতিক্রম শুধু পাট খাত।

এই ছয় মাসে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ২৮ শতাংশের বেশি। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ২৬ শতাংশ। কৃষি পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ২৫ শতাংশের মতো। হিমায়িত মাছে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২১ দশমিক ২০ শতাংশ। হোম টেক্সটাইল রপ্তানি বেড়েছে ৩১ শতাংশ। স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ২০৮ শতাংশ। ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে ২২ দশমিক ২১ শতাংশ।

এ ছাড়া ওষুধ (২২.২১%), প্রকৌশল পণ্য (৬৮%), হ্যান্ডিক্রাফট (২৯%), বাইসাইকেল (২৩.২৬%), আসবাবপত্র (৪০%), সিরামিক পণ্যসহ (৩৩.৩৩%) আরও কিছু অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানিতেও ভালো সাফল্য এসেছে।

হতাশা কেবল পাটে। বাংলাদেশের সোনালি আঁশ পাটের ‘সোনালি দিন’ ফিরে আসার হাতছানি দেখা দিয়েছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে। ওই বছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১১৬ কোটি ১৫ লাখ (১.১৬ বিলিয়ন) ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে রপ্তানি তালিকায় চামড়াকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছিল এই খাত। আগের অর্থ বছরের (২০১৯-২০) চেয়ে রপ্তানি বেড়েছিল ৩১.৬৩ শতাংশ।

সেই সুদিন ফুরিয়ে গেছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে ৫৯ কোটি ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে আয় হয়েছিল ৬৬ কোটি ৮১ লাখ ডলার। এই ছয় মাসের লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৬৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

এই হিসাবেই জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে পাট খাতে রপ্তানি আয় কমেছে ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমেছে ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

বছরের পর বছর লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) ২৫টি পাটকল ২০২০ সালের ১ জুলাই বন্ধ করে দেয় সরকার। সে কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো পাটকল এখন উৎপাদনে নেই; সরকারিভাবে পাট ও পাটজাত পণ্য এখন আর রপ্তানি হয় না। অথচ বন্ধ হওয়ার আগে বিজেএমসির পাটকলগুলো থেকে এ খাতের রপ্তানির ২০ শতাংশের মতো আসত।

এ প্রসঙ্গে বিজেএমসির চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের পাটকলগুলো এখন উৎপাদনে নেই। তাই রপ্তানিও নেই।’

তিনি বলেন, ‘বন্ধ পাটকলগুলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দিয়ে চালুর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পাঁচটি পাটকল বেসরকারি পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেয়া হয়েছে। শিগগিরই সেগুলো উৎপাদনে যাবে। তখন আগের মতো রপ্তানিও করা হবে।’

সব খাতের রপ্তানি বাড়লেও পাট রপ্তানি কমছে কেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে আব্দুর রউফ বলেন, ‘বিজেএমসি যেহেতু রপ্তানিতে নেই, সে কারণে আমার পাটের রপ্তানি বাজার সম্পর্কে খুব একটা খোঁজখবর রাখা হয় না। তবে রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে আলাপ করে যতটুকু জেনেছি তা হলো, জাহাজ ভাড়া দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।

‘একই সঙ্গে স্থানীয় বাজারে পাটের দামও এবার বেশি। প্রতি মণ তিন-সাড়ে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে পাটপণ্যের দাম খুব একটা বাড়েনি। সে কারণে আমাদের রপ্তানিকারকরা এ খাতের পণ্য রপ্তানি থেকে খুব একটা লাভ পাচ্ছেন না। রপ্তানিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন; তাই রপ্তানিও কমছে।’

বাংলাদেশ পাটপণ্য রপ্তানিকারক সমিতির (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসাইন সোহেল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত অর্থবছরে রপ্তানি বাড়ায় আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম, আমাদের সোনালি আঁশ পাটের সুদিন হয়তো ফিরে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সে আশায় গুড়েবালি।’

তিনি বলেন, ‘সবাই আশা করেছিল, কোভিড-১৯ মহামারি পরিবেশের ক্ষেত্রে নতুন ভাবনার জন্ম দেয়ায় পাটপণ্যের চাহিদা অনেক বেড়ে যাবে। এ খাতের সম্ভাবনাও দেখা দেবে নতুন করে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন দেশের ক্রেতারা পাটের পরিবর্তে কটন ও সিল্ক দিয়ে তৈরি পণ্য কিনছেন। পলি ফাইবারও ব্যবহার করছেন অনেকে। পাটজাত পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ক্রেতারা।

‘গত বার যে আমাদের রপ্তানি ৩২ শতাংশের মতো বেড়েছিল, তা কিন্তু দাম বেশি হওয়ার কারণে। পরিমাণগত দিক দিয়ে এ খাতের রপ্তানি বাড়েনি। যে বাড়তি আয় হয়েছিল, সেটা আসলে দাম বেশি হওয়ার কারণে হয়েছিল।’

বড় বিস্ময় পোশাক খাত

স্বাধীনতার পর পণ্য রপ্তানির তালিকায় তৈরি পোশাকের কোনো নাম–নিশানা ছিল না। সেই পোশাক খাতের রপ্তানি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের, টাকার অঙ্কে যা ছিল প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। করোনার ধাক্কায় গত ২০২০-২১ অর্থবছর তা কিছুটা কমে ২ হাজার ৭৯৪ কোটি ডলারে নেমে এসেছিল।

এখন সুবাতাস বইছে। পোশাকের ভালো দামও পাচ্ছেন রপ্তানিকারকরা। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ছয় মাসেই (জুলাই-ডিসেম্বর) প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি মুদ্রা এসেছে এই খাত থেকে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৮ দশমিক ০২ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১৫ দশমিক ১৯ শতাংশ।

ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে ৮০ দশমিক ৫৭ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। এর মধ্যে নিট পোশাক থেকে এসেছে ১ হাজার ১৬৬ কোটি ১৬ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩১ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে বেশি এসেছে ১৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ৮৭৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। আয় বেড়েছে ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

এ ছাড়া এই ছয় মাসে ৬৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার এসেছে কৃষি পণ্য রপ্তানি থেকে। হোম টেক্সটাইল থেকে এসেছে ৭১ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ৫৬ কোটি ৩৯ লাখ ডলার এসেছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে। হিমায়িত মাছ রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৩৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। ওষুধ রপ্তানি থেকে এসেছে ১০ কোটি ৫৫ লাখ ডলার।

২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৮ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার আয় করে বাংলাদেশ, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।

২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি (৩৩.৬৭ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম।

পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান রপ্তানি আয়ের এই উল্লম্ফনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সত্যিই আমরা খুশি। এত দ্রুত করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে আমরা ঘুরে দাঁড়াব, ভাবতে পারিনি।

‘তবে, করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন আমাদের নতুন চিন্তার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। জানি না, কী হবে। যদি ওমিক্রন সার বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে আমাদের রপ্তানি আবার থমকে যাবে। আর যদি, তেমনটা না হয়, তাহলে এই ইতিবাচক ধারা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।’

নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা ওমিক্রনকে পর্যবেক্ষণ করছি। সব কিছুই নির্ভর করছে করোনার এই নতুন ধরনের ওপর। যদি ওমিক্রনের ছোবল বিশ্বে ছড়িয়ে না পড়ে, তাহলে আগামী দিনগুলোতেও রপ্তানি আয়ের এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে। একটা ভালো প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমরা অর্থবছর শেষ করতে পারব।’

অর্থনীতির গবেষক বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে এখন রপ্তানি খাত। সত্যিই অবাক করার মতো উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে এই খাতে। এই যে করোনার ধকল সামলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তাতে সবচেয়ে বড় অবদান রেখে চলেছে রপ্তানি আয়।’

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য ও সেবা মিলিয়ে মোট ৫১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ধরেছে সরকার। এর মধ্যে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় ধরা হয়েছে সাড়ে ৪৩ বিলিয়ন ডলার।

সার্বিক রপ্তানি পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চলতি অর্থবছরে আমাদের রপ্তানি ৫২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে, যা হবে একটি মাইলফলক। বাংলাদেশের ৫০ বছরের বড় অর্জন।’

এ বিভাগের আরো খবর