সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে সারি সারি খেজুরগাছ। পৌষ মাস। চারদিক ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা। ভোরের আকাশে সূর্য তখনও ওঠেনি।
হাতে মাটির হাঁড়ি নিয়ে চলছেন এক যুবক। সঙ্গে রয়েছে তার সহযোগী। সহযোগীকে নিচে দাঁড় করিয়ে তরতর করে গাছ বেয়ে ওপরে উঠছে যুবক। রসের হাঁড়ি নামিয়ে বড় প্লাস্টিকের পাত্রে রাখছে। আবার আরেকটা গাছে উঠছেন। এভাবে রস নামিয়ে জড়ো করছেন বড় গামলায়। গাছের নিচে ততক্ষণে জমেছেন খেজুর রসের ক্রেতারা।
ছাঁকুনি দিয়ে ছেকে প্রতি কেজি খেজুর রস ৮০ টাকায় বিক্রি শুরু হলো। কেউ বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। কেউবা গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে এক চুমুকেই রস খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে।
খেজুরের রস বিক্রিই জমজমাট ব্যবসা কুমিল্লা বুড়িচং উপজেলার জঙ্গলবাড়ী এলাকার আরিফের।
কুয়াশার ভোরে খেজুরের রস পান করতে জেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে নিভৃত এই পল্লীতে এসেছেন পার্থ প্রতিম। এক চুমুকে এক মগ রস পান করে পার্থ বলেন, ‘আমার নানার বাড়ি শরীয়তপুর। ছোটবেলায় শীতের ছুটিতে যেতাম খেজুরের রস খেতে। এখন ব্যস্ততার কারণে আর যাওয়া হয় না। পাশাপাশি এখন খেজুর রস খুব একটা বেচাবিক্রি হয় না। বহু সন্ধান করে জঙ্গলবাড়ীতে এসে খেজুরের রস খুঁজে পেয়েছি। দারুণ স্বাদ।’
ওই এলাকার বাসিন্দা হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘১০ থেকে ১৫ বছর ধরে খেজুরের রস খুব একটা দেখা যায় না। অথচ একটা সময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে গাছিরা রস বিক্রি করতেন। এ বছর এক যুবক সড়কের পাশের খেজুরগাছ থেকে রস নামানো শুরু করেছে। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন ছুটে আসেন খেজুরের রস পান করতে। তাদের দেখে মনে হয় না টাকার কোনো সমস্যা। তাদের দরকার নির্ভেজাল সতেজ রস।’
জঙ্গলবাড়ী এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা লিয়াকত আলী বলেন, ‘আমরা ছোডুকালে চুরি কইরা কত রই খাইছি। আমরার সময় আগুন মাস (অগ্রহায়ণ মাস) আইলে বাড়ি বাড়ি খেজুরগাছে তালি (রস নামানোর জন্য গাছ পরিষ্কার করা) দিত। রই দিয়া ফিন্নি রাইন্ধা খাইছি। রই জাল দিয়া আধরই (ঝোলা গুড়) বানাইয়া খোলা পিডা (চিতই পিঠা) দিয়া খাইতাম। কেরুম মজা আছিল না খাইলে বুজদা না। এহনকার পোলাপানরা এডি বুঝত না। হারাদিন বইয়া বইয়া মোবাইল টিফে।’
স্থানীয়রা জানান, প্রবাসফেরত যুবক আরিফ কয়েক বছর আগে ভিসা জটিতলায় দেশে ফিরে এসে মুরগির খামার করেন। নার্সারি করেছেন। তবে তেমন সফলতা পাননি। কী করবেন ভেবে পাননি। তার পরই খেজুর গাছের রস বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেন।
আরিফ বলেন, ‘তখন কার্তিক মাস। হালকা কুয়াশা পড়ে। আমি বাড়ির পাশে বসে আছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম বাড়ির আশপাশে প্রচুর খেজুরগাছ। অগ্রহায়ণ, পৌষ ও মাঘের শীতে খেজুর গাছগুলো থেকে প্রচুর রস সংগ্রহ করা যাবে। সেই চিন্তা থেকে কাজ শুরু করলাম। গুনে দেখলাম আমার বাবা-চাচাদের ১১টি খেজুরগাছ আছে। প্রতিবেশীদের আছে আরও ৪২টি খেজুরগাছ।
‘প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি। এই তিন মাস গাছ থেকে রস নামানোর জন্য প্রতিটি গাছের জন্য ২০০ টাকা করে দিতে হবে। আমি রাজি হলাম।’
শীতের তিন মাস খেজুরগাছ থেকে রস নামানো যাবে। গাছ পরিষ্কার শুরু করেন আরিফ। গাছের মাথা পরিষ্কার ও রস নামানোর প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে প্রতিটি গাছের জন্য গাছিকে ৪০০ টাকা করে দিয়েছেন। সব মিলিয়ে তার খরচ হয়েছে ৩০ হাজার টাকা।
আরিফ আরও জানান, ৫৩টি গাছ থেকে একসঙ্গে রস নামানো যায় না। পালা করে রস নামাতে হয়। এক দিন ২৫টি গাছ থেকে রস নামালে পরদিন বাকি ১৭টি গাছ থেকে রস নামাতে হয়।
গড়ে প্রতিদিন ৯০ লিটার রস বিক্রি করতে পারেন আরিফ। প্রতি লিটার রসের জন্য ৮০ টাকা নেন। অগ্রহায়ণ থেকে শুরু হয়েছে। এখন পৌষ মাস। আসছে মাঘ মাস পর্যন্ত রস নামানো ও বিক্রি চলবে। এতে খরচ বাদ দিয়ে আয় হবে অন্তত ৩ লাখ টাকা।
আরিফ বলেন, ‘অনাদরে থাকা খেজুরগাছগুলো এখন আমার আয়ের অবলম্বন।’
নতুন উদ্যোক্তা নিয়ে কাজ করা ভিক্টোরিয়া ই-কমার্সের অ্যাডমিন ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক কাজী আপন তিবরানী বলেন, ‘সড়কের পাশে অনাদরে পড়ে থাকা খেজুরগাছ থেকে রস নামিয়ে বিক্রি করে আরিফ যে সচ্ছলতা পেয়েছে, তা চমৎকার ব্যাপার। উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে বলব, আমাদের চারপাশে বহু কিছু আছে। শুধু বুঝেশুনে কাজ করলে সফলতা আসবে।’