ঋণখেলাপিদের বিভিন্ন সময়ে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। করোনা মহামারির মধ্যে ‘বিশেষ সুবিধার’ আওতায় এক টাকা পরিশোধ না করেও খেলাপিমুক্ত থেকেছেন তারা।
এত কিছুর পর এবার তাদের অভিনব এক সুবিধা দিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর সে সুবিধাটি হচ্ছে, ব্যাকডেটে ঋণ পরিশোধ করেও খেলাপিমুক্ত থাকতে পারছেন খেলাপিরা।
গত ৩০ ডিসেম্বর এক সার্কুলার দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছিল, ২০২১ সালে একজন ঋণগ্রহীতার যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করার কথা, তার ১৫ শতাংশ দিলে গ্রাহক খেলাপি হবে না। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে দিয়েছে, ৩০ ডিসেম্বরের নির্দেশনার আলোকে কেউ আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ঋণের ১৫ শতাংশ পরিশোধ করলেও আর খেলাপি করা যাবে না।
বিভিন্ন মহলের চাপে এবং খেলাপি ঋণ কম দেখানোর সবশেষ উপায় হিসেবে এ পন্থা বেছে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে সার্কুলার বা চিঠি দিয়ে নয়, ব্যাংকগুলোকে টেলিফোন করে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে একাধিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেসরকারি এক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোমবার রাতে নিউজবাংলাকে, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে ওই পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করলেই সুযোগটি পাওয়ার কথা। এখন ব্যাকডেট বা পেছনের তারিখে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিতে বলা হয়েছে। আমাদের টেলিফোনে বলা হয়েছে, কেউ যদি ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ঋণের ১৫ শতাংশ পরিশোধ করে, তাহলে তাকে আর খেলাপি হিসেবে চিহ্নত করা যাবে না।’
ব্যাকডেটে ঋণ পরিশোধ করে খেলাপিমুক্ত থাকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সুযোগ ‘অনৈতিক’ বলে মন্তব্য করেন ওই ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
ব্যাংকারদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, কিছু গ্রাহকের ধারণা ছিল ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর দাবির মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শেষ পর্যন্ত এবারও ঢালাওভাবে ঋণ পরিশোধ না করলেও খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ দেবে। এ ধরনের কিছু ব্যবসায়ী তাদের হাতে টাকা থাকা সত্ত্বেও ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রয়োজনীয় অংশ পরিশোধ করেনি। তাদের খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ দিতেই আগামী ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ব্যাংকাররা জানান, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো যাচ্ছে। ব্যাংকের ঋণ শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ব্যাংকগুলো চাচ্ছে ঢালাও সুবিধা আর না দিতে। যে কারণে গত বছরের জানুয়ারিতে এক সার্কুলারের মাধ্যমে প্রথমে জানানো হয়, সুবিধা আর বাড়ানো হবে না।
পরে গত ২৭ আগস্ট এক সার্কুলারের মাধ্যমে বলা হয়, ২০২১ সালে একজন ঋণগ্রহীতার যে পরিমাণ পরিশোধ করার কথা কেউ ২৫ শতাংশ দিলে আর খেলাপি হবে না। তবে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে এবারও এক টাকাও পরিশোধ না করে খেলাপিমুক্ত থাকার ঢালাও সুযোগ চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে অনুরোধ জানানো হয়।
গত ২৮ ডিসেম্বর ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিষয়টি আলোচনায় এলে এর বিরোধিতা করেন ব্যাংকাররা। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) খাতের কোনো উদ্যোক্তা ১৫ শতাংশ পরিশোধ করলেও খেলাপি না করার নির্দেশ দেয়।
এই বৈঠকের মাত্র দুই দিন পর ৩০ ডিসেম্বর ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ ১৫টি ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে বৈঠকের পর ওই দিন রাতে একটি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক সবার জন্য এই সুবিধা দেয়।
বছরের শেষ কর্মদিবসের (৩১ ডিসেম্বর ছিল শুক্রবার) পরে দেওয়া সুবিধা নিয়ে ওই দিনই প্রশ্ন তুলেছিলেন ব্যাংকাররা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, নানা ছাড় এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরও গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। জুন শেষে এই অঙ্ক ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা।