করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমদানিতে জোয়ার বইতে শুরু করেছে। আর এতে আমদানি-রপ্তানির মধ্যে ব্যবধান চূড়ায় উঠছে।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বাংলাদেশে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৫৩ কোটি (১২.৫৩ বিলিয়ন) ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ।
২০২০-২১ অর্থবছরের এই পাঁচ মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫০৪ কোটি ৬০ লাখ (৫.০৪ বিলিয়ন) ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক সোমবার বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের যে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ৩ হাজার ১১৬ কোটি ৬০ লাখ (৩১.১৬ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৪ শতাংশ বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই পাঁচ মাসে ২ হাজার ২৪ কোটি ১০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।
অন্যদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ১ হাজার ৮৬৩ কোটি ৬০ লাখ (১৮.৫৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি।
এ হিসাবেই অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার।
এই ধারা অব্যাহত থাকলে গত অর্থবছরের চেয়ে অনেক বেশি বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হবে বলে মনে করছেন গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘একটা স্বস্তির জায়গা হচ্ছে, আমদানির সঙ্গে রপ্তানিও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। রপ্তানির এই ইতিবাচক ধারা বেশ কিছুদিন অব্যাহত থাকবে বলে মনে হচ্ছে। তাই, আমদানি যেটা বাড়ছে, তা যদি ঠিকঠাকমতো বিনিয়োগে আসে, তাহলে অর্থনীতির জন্য ভালো হবে।
‘আশার কথা হচ্ছে, পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে আগামী বছর থেকেই যান চলাচল করবে। মেট্রোরেলও পুরোদমে চালু হবে। কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজও শেষ হবে। এ ছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ আরও কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজও এগিয়ে চলছে। কয়েকটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শেষের পথে। এসব বড় প্রকল্প বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ভিন্নমাত্রা যোগ করবে।
‘আর এসব উন্নয়নযজ্ঞকে কেন্দ্র করেই বিনিয়োগের ছক কষছেন উদ্যোক্তারা। সে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পণ্য সরঞ্জাম আমদানি করছেন তারা। তাতেই বাড়ছে আমদানি।’
আহসান মনসুর বলেন, ‘আমদানি বাড়ায় উদ্বেগের কিছু নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এখনও পর্যন্ত রিজার্ভ আছে; সেখান থেকে আমদানির খরচ মেটাতে কোনো সমস্যা হবে না।’
সেবা বাণিজ্যে ঘাটতিও বাড়ছে
জুলাই-নভেম্বর সময়ে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৪০ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ১০০ কোটি ডলার।
মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।
লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ৬ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার
আমদানি বাড়ায় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (ব্যালান্স অফ পেমেন্ট) ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ।
চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসেই (জুলাই-নভেম্বর) এই ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬১৮ কোটি ৬০ লাখ (৬.১৮ বিলিয়ন) ডলার। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে এই সূচক ৩৫৫ কোটি ৫০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছর শুরুই হয়েছিল লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি নিয়ে। প্রথম তিন মাসে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৩১ কোটি ৪০ লাখ (২.৩১ বিলিয়ন) ডলার। চার মাস শেষে (জুলাই-অক্টোবর) তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৭৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
নভেম্বর শেষে তা আরও বেড়ে ৬ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে।
আহসান মনসুর বলেন, ‘আমদানি বাড়ায় আর রেমিট্যান্সের ধীরগতির কারণে বৈদেশিক লেনদেনে এই ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তবে, এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আমদানি বাড়ার ভালো দিকও আছে। দেশে বিনিয়োগ বাড়বে; কর্মসংস্থান হবে। অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হবে।’
প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল গত ২০২০-২১ অর্থবছর। নয় মাস পর্যন্তও (জুলাই-মার্চ) এই সূচক উদ্বৃত্ত ছিল। কিন্তু আমদানি বেড়ে যাওয়ায় এপ্রিল থেকে ঘাটতি (ঋণাত্মক) দেখা দেয়।
বেশ কয়েক বছর পর সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যেও ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ।
৯২৭ কোটি ৪০ লাখ (৯.২৭ বিলিয়ন) ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। তার আগের বছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৩১৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার।
আমদানি বাড়ায় অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবে ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ
আর্থিক হিসাবে এখনও উদ্বৃত্ত
তবে আর্থিক হিসাবে এখনও উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। জুলাই-নভেম্বর সময়ে এই উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে ৪৫৮ কোটি ৯০ লাখ (৪.৫৮ বিলিয়ন) ডলার। গত বছরের এই সময়ে ১৪৭ কোটি ৩০ লাখ ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল।
করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ অন্য দাতাদেশ ও সংস্থার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ঋণসহায়তা পাওয়ায় আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্ত হয়েছে বলে জানান আহসান মনসুর।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, এই পাঁচ মাসে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ৩০১ কোটি ৩০ লাখ ডলার ঋণসহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫১ শতাংশ বেশি।
রেমিট্যান্স কমেছে ২১ শতাংশ
এই পাঁচ মাসে ৮৬০ কোটি ৯০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২০ দশমিক ৯৭ শতাংশ কম। ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ১ হাজার ৮৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
করোনা মহামারির মধ্যেও গত অর্থবছরে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।
কিন্তু, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই এই সূচকে নেতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ২ বিলিয়ন ডলার
সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যেও (ওভারঅল ব্যালেন্স) ঘাটতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। জুলাই-নভেম্বর সময়ে এই ঘাটতির অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার।
অথচ গত বছরের একই সময়ে ৫ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল।