বছরের শেষ মাসে ক্রমাগতভাবে পড়তে থাকা পুঁজিবাজার নতুন বছরের দ্বিতীয় কর্মদিবসে সূচকের অবস্থান আরও একটু ভালো হয়েছে। লেনদেনও পেয়েছে গতি।
১৩ কর্মদিবস পর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের লেনদেন ছাড়াল এক হাজার কোটি টাকার ঘর। গত ৭ ডিসেম্বর পুঁজিবাজার নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পরে এত বেশি লেনদেন দেখা যায়নি।
সপ্তাহ ও বছরের দ্বিতীয় কর্মদিবসে হাতবদল হয়েছে এক হাজার ৩১৪ কোটি ১৪ লাখ ২০ হাজার টাকার শেয়ার। গত ৭ ডিসেম্বর লেনদেন ছিল এক হাজার ৩৩১ কোটি ৪ লাখ ৫২ হাজার টাকা।
তবে অর্থবছরের প্রথম দিন ৯৬ পয়েন্ট সূচক বৃদ্ধির স্মৃতি নিয়ে দ্বিতীয় দিনের লেনদেনের শেষ অংশের প্রবণতা বিনিয়োগকারীদেরকে খুব একটা খুশি করবে না। কারণ, বলো ১২টা ৩৯ মিনিটে আগের দিনের চেয়ে সূচক ৬৯ পয়েন্ট বেড়ে লেনদেন হচ্ছিল এবং তা ছিল ঊর্ধ্বমুখি। সে সময় আশা করা হচ্ছিল, আগের দিনের মতোই বড় উত্থান হবে।
তবে দিনের শেষাংশে সেই অবস্থান থেকে সূচক কমে ৪০ পয়েন্ট, যে কারণে ২৯ পয়েন্ট যোগ করে লেনদেন শেষ হওয়াটা বিনিয়োগকারীদের জন্য খানিকটা নেতিবাচক বার্তাই দিয়েছে।
দিন শেষে বেড়েছে ২১৭টি কোম্পানির শেয়ারদর, কমেছে ১৩২টির। দর অপরিবর্তিত আছে ২৮টির।
খাত হিসাব করলে সবচেয়ে বেশি কোম্পানির দর বেড়েছে মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতে। দারুণ দিন গেছে বস্ত্র ও বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতেও। ওষুধ ও রসায়ন এবং প্রকৌশল খাতেও গেছে ভালো দিন। সাধারণ বিমা খাতে খুব একটা ভারো সময় না গেলেও জীবন বিমা খাতের কোম্পানিগুলোর দর বেড়েছে প্রায় সবগুলোর।
অন্যদিকে ব্যাংক, আর্থিক, সাধারণ বিমা খাতে খুব একট ভালো দিন কাটেনি।
সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে বিবিধ খাতে। বেশ কিছুদিন পর দুই শ কোটি টাকা ছাড়াল এই খাতটি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে বিমাতে। এর পরের অবস্থানগুলো হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, বস্ত্র, ব্যাংক, প্রকৌশল, চামড়া।
টানা তৃতীয় দিন সূচক বাড়ল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে। সোমবার লেনদেনের অর্ধেক সময় সূচক অনেকটা বাড়লেও শেষ বেলায় কিছুটা কমে
গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া দর সংশোধনের মধ্যে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে দ্বন্দ্বের যে বিষয়গুলো সামনে এসেছে, তা উপসমের আশা নিয়ে বিনিয়োগকারীরা তাকিয়ে ছিল ৭ ডিসেম্বরের বৈঠকে। তবে সেই বৈঠক শেষে কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা আসেনি। জানানো হয়, ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা আসবে।
ডিসেম্বরের শেষে সেই বৈঠক হয়নি। এখন বিনিয়োগকারীরা জানুয়ারির শুরুর সেই বৈঠকের অপেক্ষায়। তবে কবে বসবে মন্ত্রণালয়, তার দিনক্ষণ এখনও ঠিক হয়নি।
তার পরেও বছর শেষে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিক্রয় চাপ শেষ হয়েছে। মুনাফা নিয়ে নেয়ার পর অর্থবছরের হিসাবনিকাশ শেষে তারা আবার শেয়ার কেনা শুরু করেছে। সেই সঙ্গে নিষ্ক্রিয় বসে থাকা ব্যক্তিশ্রেণির বিনিয়োগকারীরাও সক্রিয় হতে শুরু করেছে বলেই মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
মন্ত্রণালয়ের প্রতিশ্রুত সেই বৈঠকের দিনক্ষণ নির্ধারণ হলে এবং সেখান থেকে ইতিবাচক কোনো ঘোষণা এলে এই সক্রিয়তা আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
পতনের ধাক্কা থেকে বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবেক প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা দেবব্রত কুমার সরকার।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘নতুন করে দুদিনের উত্থান বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। সেটি যদি আরও কয়েকদিন অব্যাহত থাকে থাকলে বিনিয়োগকারিরা নতুন করে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হবে।’
পুঁজিবাজারে নেতিবাচক কোনো বার্তা নেই বলে মনে করেন দেবব্রত। তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই উত্থানে। পাশাপাশি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিএসইসিও নানা উদ্যোগের মাধ্যমে পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত না হয়ে শেয়ার ধরে রাখলেও ভালো রির্টান পাওয়া সম্ভাবনা আছে এই বাজারে।’
সূচক বাড়াল যেসব কোম্পানি
সূচক যে পরিমাণ বেড়েছে, তার চেয়ে কিছুটা বেশি বড়িয়েছে কেবল ১০টি কোম্পানি।
টানা দ্বিতীয় দিন সূচকে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট যোগ করেছে ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো কোম্পানি। বেক্সিমকো লিমিটেডের অবদান দ্বিতীয়।
প্রথম কোম্পানির শেয়ারদর বেড়েছে ১.০৫ পয়েন্ট, দ্বিতীয়টির ১.৮২ পয়েন্ট।
সার্বিকভাবে সোমবার সূচক যত বেড়েছে, এই ১০টি কোম্পানিই যোগ করেছে তার চেয়ে বেশি
এই দুটি কোম্পানি যথাক্রমে ৬.৬১ ও ৪.৪২ পয়েন্ট সূচক বাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে ১০টি কোম্পানিই সূচক বাড়িয়েছে ২৯.৫৭ পয়েন্ট।
রবি, ইউনাইটেড পাওয়ার, পাওয়ারগ্রিড, ব্র্যাক ব্রাংক, বেক্সিমকো ফার্মা, ফরচুন সুজ, স্কয়ার ফার্মা, লাফার্জ হোলসিম সিমেন্ট বাকি আটটি কোম্পানি।
বিপরীতে সবচেয়ে বেশি ৪.৩৮ পয়েন্ট সূচক হারিয়েছে গ্রামীণ ফোনের ০.৫১ শতাংশ দরপতনে। দুই মাস ধরে অবিশ্বাস্য উত্থান শেষে পরপর দ্বিতীয় দিন সর্বোচ্চ পরিমাণ দর হারানো সোনলী পেপারের কারণ সূচক কমেছে ২.৬৬ পয়েন্ট।
ডেল্টা লাইফ, বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি, রেকিট বেনকিনজার, ইসলামী ব্যাংক, জেনেক্স ইনফোসিস, লিনডে বিডি, ইউনিলিভার ও বিএসআরএম লিমিটেডের দরপতনেও সূচক কমেছে সবচেয়ে বেশি।
এই ১০টি কোম্পানির কারণেই সূচক থেকে কমেছে ১৬.০৭ পয়েন্ট।
এই ১০টি কোম্পানি সূচক কমিয়েছে ১৬ পয়েন্টের বেশি
দর বৃদ্ধির শীর্ষ ১০
দিনে দর বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়েছে পাঁচটি কোম্পানি। সবকটির দর বেড়েছে ৯ শতাংশের বেশি।
শীর্ষ দশে বেশ কয়েক মাস পর মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতের বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে দেখা গেছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দর বেড়েছে ইজেনারেশনের ৯.৯৮ শতাংশ। গত ১০ কর্মদিবসে কোম্পানিটির দর বেড়েছে ৫দিন।
৩ কোটি ২৪ লাখ টাকায় কেম্পানিটির ৬ লাখ ২০ হাজার ৪০৪টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স, যার দর বেড়েছে ৯.৯৪ শতাংশ। ৫৭ টাকা ৩০ পয়সা থেকে বেড়ে দর হয়েছে ৬৩ টাকা। ৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকায় হাতবদল হয়েছে ৭ লাখ ১৮ হাজার ১০০টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
লাভেলো আইসক্রিমের শেয়ার দর ৯.৭৫ শতাংশ, রিং সাইন টেক্সটাইলের ৯.২৭ শতাংশ এবং আর এন স্পিনিংয়ের দর বেড়েছে ৯.০৯ শতাংশ।
আট শতাংশের বেশি শেয়ার দর বেড়েছে তিনটি কোম্পানির। এর মধ্যে আমান ফিডের দর বেড়েছে ৮.৯০ শতাংশ। বাকি দুটি ছিল মিউচ্যুয়াল ফান্ড খাতের।
আইসিবি এএমসিএল থার্ড মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দর ৮.৮২ শতাংশ ও প্রাইম ফাইন্যান্স ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ৮.৪২ বেড়েছে শতাংশ।
দর বৃদ্ধির শীর্ষ তালিকায় নবম অবস্থানে থাকা রিলায়েন্স ওয়ান মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ইউনিট মূল্য বেড়েছে ৭.১৪ শতাংশ এবং নুরানী ডায়িংয়ের বেড়েছে ৬.৯৪ শতাংশ।
আরও ৩টির দর ৬ শতাংশের বেশি, ৬টির দর ৫ শতাংশের বেশি, ৯টির দর ৪ শতাংশের বেশি, ২৩টির দর ৩ শতাংশের বেশি, ৪১টি কোম্পানির দর বেড়েছে ২ শতাংশের বেশি।
বেক্সিমকোর লেনদেন বাড়ায় বিবিধ খাত আবার চাঙা হয়ে উঠেছে
দর পতনের শীর্ষ কোম্পানি
টানা দ্বিতীয় দিন সবচেয়ে বেশি দর হারিয়েছে সোনালী পেপার। আগের দিন ৬.২৫ শতাংশের পর দ্বিতীয় দিন দর কমেছে ৭.৪৯ শতাংশ। ১০ লাখ ২ হাজার ২৯০টি শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৮ কোটি ৫৪ লাখ ৮৪ হাজার টাকায়।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা লিবরা ইনফিউশনের দর কমেছে ৪.৫৭ শতাংশ। কোম্পানিটির ১ কোটি ৭৪ লাখ টাকার ১৮ হাজার ৫১১টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
তৃতীয় অবস্থানে থাকা এএমসিএল (প্রাণ) কোম্পানির শেয়ার দর কমেছে ৪.২৬ শতাংশ। ২৯২ টাকা ৮০ পয়সা দরের শেয়ার কমে হয়েছে ২৮০ টাকা ৩০ পয়সা।
রেনউইক যজ্ঞেশ্বর কোম্পানির শেয়ার দরও কমেছে ৪ শতাংশের বেশি। ১ হাজার ৯৭ টাকা ৬০ পয়সা দরের শেয়ার ৪.২৩ শতাংশ কমে হয়েছে ১ হাজার ৫১ টাকা ১০ পয়সা।
ঢাকা ডাইংয়ের দর কমেছে ৩.৮৪ শতাংশ। ৯ কোটি ৫৭ লাখ টাকার মোট ৩৭ লাখ ৪৭ হাজার ১৬৬টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
এছাড়া বিচ হ্যাচারির দর ৩.৭২ শতাংশ, ডেফোডেল কম্পিউটারসের দর দর ৩.৫৯ শতাংশ, জেনেক্স ইনফোসিসের দর কমেছে ৩.৩৯ শতাংশ।
এটলাস বাংলাদেশ, ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স, জেমিনি সি ফুড, আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, ডেল্টা লাইফের শেয়ার দর কমেছে তিন শতাংশের বেশি।
লেনদেন বেড়েছে প্রধান প্রায় সব খাতেই
লেনদেনে সেরা দশ
টাকার অঙ্কে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছে বেক্সিমকো লিমিটেডের। ১৮১ কোটি ৭৭ লাখ টাকায় ১ কোটি ১৫ লাখ ১৯ হাজার ৯৩৭টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৭২ কোটি ৯৮ লাখ টাকার। ৮৯ লাখ ১৩ হাজার ৬৩৯টি শেয়ার এদিন হাতবদল হয়েছে।
ফরচুন সুজের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৬৯ কোটি ৫০ লাখ টাকার। শেয়ার হাতবদল হয়েছে ৬৪ লাখ ৪১ হাজার ২১৫টি।
পাওয়ারগ্রিডে লেনদেন হয়েছে ৪৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকার। পেনিনসুলায় লেনদেন হয়েছে ২৮ কোটি ৫ লাখ টাকার।
এছাড়া ডেল্টা লাইফে ২৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, বিকন ফার্মায় ২৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, আইএফআইসি ব্যাংকে ২২ কোটি ১৬ লাখ টাকা, সাইফ পাওয়ারটেকে ১৯ কোটি ৫ লাখ টাকা, জেনেক্স ইনফোসিসে ১৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ওয়ান ব্যাংকে ১৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা হাতবদল হয়েছে।