২০২১ সালের প্রথম কর্মদিবসে যতটা হয়েছিল, ততটা না হলেও নতুন বছরের প্রথম দিনও বড় উত্থান দেখল পুঁজিবাজার। পতনের মধ্যে থাকা বাজারে এক দিনেই সূচক বাড়ল প্রায় এক শ পয়েন্ট।
গত সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দর সংশোধনে থাকা পুঁজিবাজার অর্থবছরের শেষ মাসে দেখে আরও পতন। গত ৭ ডিসেম্বর বাজার নিয়ে দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসিকে নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বৈঠক থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না আসার পর পতন হতে থাকে। বছরের শেষ দিন সূচক ২৫ পয়েন্ট বাড়লেও সেই দিনের পর ১৬ দিনে কমে ২৯২ পয়েন্ট।
অর্থবছরের শেষে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মুনাফা তুলে নেয়ার প্রবণতা থাকে। সে সময় নতুন বিনিয়োগে যাওয়ার ঘটনা সচরাচর ঘটে না। এর মধ্যে পুঁজিবাজার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসির মধ্যে মতভিন্নতার বিষয়টি সামনে আসার পর হাত গুটিয়ে বসে থাকে ব্যক্তি শ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীরাও।
এই অবস্থায় নতুন বছরের প্রথম দিন বাজারে কী আচরণ হয়, তা নিয়ে দৃষ্টি ছিল বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। রোববারের আচরণে কিছুটা হলেও আশাবাদী হতে পারে তারা।
সকাল ১০টায় লেনদেন শুরুই হয় ২২ পয়েন্ট সূচক বেড়ে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সূচকে যোগ হতে থাকে আরও পয়েন্ট। এক পর্যায়ে বেলা দুইটায় সূচক আগের দিনের চেয়ে ১০৪ পয়েন্ট বেড়ে লেনদেন হতে থাকে। সে সময় সূচক আরও বাড়ছিল। তবে এর পরের আধা ঘণ্টায় সেখান থেকে কিছুটা কমে। দিন শেষে ৯৬.৪৮ পয়েন্ট বেড়ে সূচক দাঁড়ায় ৬ হাজার ৮৫৩ পয়েন্টে।
সূচকের এই অবস্থান গত ১৫ ডিসেম্বরের পর সর্বোচ্চ। সেদিন সূচক ছিল ৬ হাজার ৮৬৮.১ পয়েন্ট।
অর্থবছরের প্রথম দিন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেনের চিত্র
এদিন লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে বেড়েছে ২৬৪টির দর, কমে ৬৪টির। আর দর অপরিবর্তিত থাকে ২০টির।
২০২১ সালের প্রথম কর্মদিবসেও সূচকের উত্থান দেখেছিল পুঁজিবাজার। সে বছর প্রথম দিনে সূচক বেড়েছিল ২১৬.৮৯ পয়েন্ট। তার আগের বছরের শেষ মাসেও বাজারে ছিল চাঙাভাব।
তবে লেনদেনের দিক থেকে বিবেচনা করলে ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায় দুই বছরের প্রথম দিনে।
২০২১ সালের প্রথম কর্মদিবসে হাতবদল হয়েছিল ১ হাজার ৯২৫ কোটি ৭৭ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। এবার তা হয়েছে অর্ধেক মাত্র।
আস্থাহীনতার বাজারে নতুন বছরের প্রথম দিন হাতবদল হয়েছে ৮৯৪ কোটি ১৭ লাখ ৮৪ হাজার টাকা মাত্র।
চাঙাভাব দেখা গেছে প্রায় সব খাতেই। তবে কোম্পানির সংখ্যার বিবেচনায় ভালো দিন সবচেয়ে বেশি গেছে বস্ত্র খাতে। ব্যাংক, আর্থিক, প্রকৌশল, খাদ্য, তথ্য প্রযুক্তি, বিবিধ, ওষুধ রসায়ন খাতের বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারধারীদের বিও হিসাবেই যোগ হয়েছে টাকা।
খাতওয়ারি সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল বিবিধতে। এই খাতের প্রধান কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেডই এর কারণ। এর পরের অবস্থানগুলো যথাক্রমে, বিমা, ব্যাংক, ওষুধ রসায়ন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, বস্ত্রতে।
উত্থানে ভূমিকা যাদের
নতুন বছরের প্রথম কর্মদিবসে সূচকের ব্যাপক উত্থানে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে খাদ্য ও আনুষাঙ্গিক খাতের বৃটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ (বিএটিবিসি)। এদিন কোম্পানিটির শেয়ার দর ১.৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় সূচক বেড়েছে ১১ পয়েন্ট।
৯.৬৯ শতাংশ সূচক বাড়িয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বেক্সিমকো লিমিটেড। কোম্পানিটির শেয়ার দর বেড়েছে ৩.৮৪ শতাংশ।
লাফার্জ হোলসিম বাংলাদেশ লিমিটেড আর ব্যাংক খাতের আইএফআইসি ব্যাংক সূচক বৃদ্ধিতে যথাক্রমে ৭.২১ শতাংশ ও ৪.২৯ পয়েন্ট অবদান রেখেছে।
সূচক যত বেড়েছে, তার অর্ধেকেই বাড়িয়েছে এই ১০ কোম্পানি
বেক্সিমকোফার্মা শেয়ার দর বেড়েছে ২.৩৪ শতাংশ। এতে সূচক বেড়েছে ৩.৯ শতাংশ। পাওয়ারগ্রিডের শেয়ার দর ৩.৩৬ শতাংশ বাগার কারণে সূচক বেড়েছে ২.৭৭ পয়েন্ট। ফরচুন সুজের শেয়ার দর ৯.৯৯ শতাংশ বৃদ্ধিতে সূচক বেড়েছে ২.৭৬ পয়েন্ট।
বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানির শেয়ার দর ৯.৮৭ শতাংশ বাড়ায় সূচক বেড়েছে ২.১ পয়েন্ট। বার্জারপেইন্টস ২.০৮ পয়েন্ট ও ইউনাইটেড পাওয়ার সূচক বাড়িয়েছে ২.০২ পয়েন্ট।
সব মিলিয়ে এই ১০টি কোম্পানি সূচক বাড়িয়েছে ৪৮.০১ পয়েন্ট।
অন্যদিকে এক মাসে ৪১৩ টাকা বা ৭৫.৮২ শতাংশ দর বৃদ্ধি পাওয়া সোনালী পেপার বছরের প্রথম দিন দর হারিয়েছে ৫৯ টাকা ৯০ পয়সা। এর প্রভাবে সূচক থেকে হারিয়েছে ২.৫৬ পয়েন্ট।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ওয়ালটনের দর কমেছে ০.৩৭ শতাংশ। সূচক কমেছে ২.৪৮ পয়েন্ট।
রেনাটা, আইসিবি, স্কয়ার ফার্মা, ব্যাংক এশিয়া, ইবিএল, বাটা শু, বিকন ফার্মা, ও ব্র্যাক ব্যাংক সূচক কিছুটা টেনে ধরার চেষ্টা করেছে।
এক ১০টি কোম্পানি মিলিয়ে সূচক কমিয়েছে ১৩.২২ পয়েন্ট।
এই ১০টি কোম্পানি সূচক নিচের দিকে টেনে ধরার চেষ্টা করেছে
দর বৃদ্ধির শীর্ষে যেসব কোম্পানি
দিনের সর্বোচ্চ দরে লেনদেন হয়েছে এমন কোম্পানি ছিল পাঁচটি। এরমধ্যে ১০ শতাংশে শেয়ার দর বেড়েছে আরএন স্পিনিং মিলসের। বন্ধ ও লোকসানি কোম্পানিটি একই মালিকের অন্য কোম্পানির সঙ্গে একীভূত হচ্ছে, এই খবরে ৬ টাকার শেয়ার ১০ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৬ টাকা ৬০ পয়সা।
নয় শতাংশের বেশি দর বৃদ্ধিতে ছিল বাকি চারটি কোম্পানি। এগুলোর মধ্যে ফরচুন সুজের শেয়ার দর বেড়েছে ৯.৯৮ শতাংশ। ৯২ টাকা ১০ পয়সা দরের শেয়ার পৌঁছেছে ১০১ টাকা ৩০ পয়সায়।
সিভিও পেট্টোক্যামিকেলের দর বেড়েছে ৯.৯৬ শতাংশ। ১১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা লেনদেনে এদিন কোম্পানিটির ৫ লাখ ৭৬ হাজার ৬২৯টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের শেয়ার দর বেড়েছে আরও ৯.৮৭ শতাংশ। লাভেলো আইসক্রিমের দর বেড়েছে ৯.৮২ শতাংশ।
সাত থেকে সাত শতাংশের বেশি শেয়ার দর বেড়েছে ছয়টি কোম্পানির। এগুলোর মধ্যে ঢাকা ডাইংয়ের দর বেড়েছে ৭.৮৮ শতাংশ। ৯ কোটি ২১ লাখ টাকায় ৩৬ লাখ ৪৪ হাজার ৪৬২টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে।
আইএফআইসি ব্যাংকের দর ৭.৬৯ শতাংশ, পেনিনসুলার ৭.৬২ শতাংশ, গোল্ডেনসনের ৭.৩৩ শতাংশ, একমি পেস্ট্রিসাইডসের দর ৭.০৯ শতাংশ, মেঘনা পেট ইন্ডাস্ট্রিজের দর বেড়েছে ৭.০৬ শতাংশ।
চারটি কোম্পানির দর ৬ শতাংশের বেশি, ১০টি কোম্পানির দর ৫ শতাংশের বেশি, ৪৩টির দর ৩ শতাংশের বেশি, ৫২টি কোম্পানির দর ২ শতাংশের বেশি, ৮৩টি কোম্পানির দর বেড়েছে এক শতাংশের বেশি।
দর পতনের শীর্ষে যারা
কাগজ ও প্রকাশনা খাতের সোনালী পেপার ছিল দর পতনের শীর্ষ তালিকায়। কোম্পানিটিতে ২৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা লেনদেন হলেও দর কমেছে ৬.২৫ শতাংশ। শেয়ার দর ৯৫৭ টাকা ৭০ পয়সা থেকে কমে হয়েছে ৮৯৭ টাকা ৮০ পয়সা।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা এটলাস বাংলাদেশের দর কমেছে ৬.২০ শতাংশ।
লেনদেনের শীর্ষে উঠে এসেছে এই ৬ কোম্পানি
চার শতাংশের বেশি শেয়ার দর পতন হওয়া একমাত্র কোম্পানি এশিয়া ইন্স্যুরেন্স। এদিন কোম্পানিটির শেয়ার দর ১১৫ টাকা থেকে ৪.৭৮ শতাংশ কমে হয়েছ ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। কাগজ খাতের আরেক কোম্পানি মনস্পুল পেপারের দর কমেছে ৩.৫৭ শতাংশ।
আরও তিনটি কোম্পানির শেয়ার দর তিন শতাংশের বেশি কমেছে। এগুলোর মধ্যে রিলায়েন্স ওয়ান মিউচ্যুয়াল ফান্ডের ৩.৪৪ শতাংশ, কেঅ্যান্ডকিউ এর দর ৩.৩২ শতাংশ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ৩.১৬ শতাংশ শেয়ার দর কমেছে।
দুই শতাংশের বেশি শেয়ার দরপতন হওয়া কোম্পানির তালিকায় ছিল বাটা শু, যার দর ২.৭৯ শতাংশ, রেনউইক যজ্ঞেশ্বরের দর ২.৩৭ শতাংশ, ব্যাংক এশিয়ার দর ২.২৯ শতাংশ, রহিম টেক্সটাইলের দর ২.১৫ শতাংশ, ন্যাশনাল টিউবের দর ২.০১ শতাংশ কমেছে।
লেনদেনে সেরা যারা
প্রায় এক শ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে বেক্সিমকো লিমিটেডের। ৬৪ লাখ ৮২ হাজার ৩৭৪টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে বিবিধ খাতের এই কোম্পানিটির।
তারপরই ছিল বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশ, যার ৫১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা লেনদেনে হাতবদল হয়েছে ৬৭ লাখ ৫৫ হাজার ৮০০টি শেয়ার।
কাগজ ছাড়া প্রায় সব খাতেই শেয়ারে দেখা গেছে চাঙাভাব
ফরচুন সুজে লেনদেন হয়েছে ৪৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। শেয়ার হাতবদল হয়েছে ৪৭ লাখ ৮৮ হাজার ২৭টি।
আইএফআইসি ব্যাংকে লেনদেন হয়েছে ৩০ কোটি ১৪ লাখ টাকার। শেয়ার হাতবদল হয়েছে ১ কোটি ৬৯ লাখ ১৪ হাজার ২৬১টি।
জিএসপি ফাইন্যান্সে লেনদেন হয়েছে ২৮ কোটি ২২ লাখ টাকা। শেয়ার হাতবদল হয়েছে ১ কোটি ১ লাখ ৪০ হাজার ৭০৬টি।
এছাড়া সোনালী পেপারে ২৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, ওয়ান ব্যাংকে ১৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা, জেনেক্স ইনফোসিসে ১৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, ডেল্টা লাইফে ১৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা, পাওয়ারগ্রিডে ১৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা, এশিয়া ইন্স্যুরেন্সে লেনদেন হয়েছে ১৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা।