সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় দলের জন্ম। দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে টেক্কা দিয়ে দোর্দণ্ড প্রতাপ। তবে ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর শীর্ষ নেতাদের একাংশ দল পাল্টে প্রধানত যান বিএনপিতে। পরে কেউ কেউ আসেন আওয়ামী লীগে।
১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত দলটি এবার পূর্ণ করেছে ৩৬ বছর। দলের ৩৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে তারা। নানা আয়োজন বক্তব্যে দাবি করছে, এখন জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা তাদের ঘিরে।
তবে এই দাবি প্রমাণ করার মতো বাস্তবতা রাজনীতিতে দৃশ্যমান নয়। এরশাদ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দলটি ক্রমেই খারাপ করছে। আর তখনই আসন বেশি পেয়েছে, যখন বড় দলের সমর্থন তারা পেয়েছে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় দলটির নেতারা জিততে পারছেনই না, এমনকি সব জায়গায় প্রার্থীও দেয়া যাচ্ছে না।
এরশাদ সরকারের পতনের পরও অবস্থান ধরে রাখা বৃহত্তর রংপুরের সংসদীয় আসন ও স্থানীয় সরকারের প্রায় সব আসনই হাতছাড়া দলটির।
এর মধ্যেও তিন বছর ধরেই নেতারা বলছেন, জনগণ প্রধান দুই দলের প্রতি হতাশ, তাকিয়ে তাদের প্রতি। যদিও জনগণের ব্যাপক সমর্থনের দাবির প্রমাণ ভোটের বাক্সে নেই।
চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপের ফলাফল ঘেঁটে দেখা গেছে গত ২৮ নভেম্বর তৃতীয় ধাপে যে ৮৫৭টি ইউনিয়নের ফল ঘোষণা করা হয়, তার মধ্যে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা জিতেছেন কেবল ১৫টিতে। অর্থাৎ মোট ইউনিয়নের ১ দশমিক ৭৫ শতাংশতে জয় পেয়েছেন দলটির প্রার্থীরা।
গত ২৬ ডিসেম্বর যে ৭৮১টি ইউনিয়নের ফল ঘোষণা হয়েছে, তার মধ্যে জাতীয় পার্টি জয় পেয়েছে আরও কম ৯টিতে। এবার মোট ইউনিয়নের মধ্যে জাতীয় পার্টি জয় পেয়েছে ১ দশমিক ১৫ শতাংশে।
দলের প্রার্থীরা হেরেছেন, এমনকি এরশাদ সরকার পতনের শক্তিশালী রংপুর অঞ্চলেও। এমনকি দলের প্রতিষ্ঠাতার জেলা রংপুরেও জয় পাননি প্রার্থীরা।
গত পৌরসভা নির্বাচনেও রংপুর-কুড়িগ্রামে অনেক এলাকায় প্রার্থীও দিতে পারেনি দলটি।
ভোটের মাঠে এই চিত্র দলেও দলক্ষয়িষ্ণু হচ্ছে- এটা মানতেই নারাজ চেয়ারম্যান জি এম কাদের। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এটা বলার আগে বলতে হবে, নির্বাচন কি অবাধ-সুষ্ঠু হচ্ছে? জনগণের মতামতের প্রতিফলন হচ্ছে? যদি তাই হয়, তাহলে আমরা ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছি। আর এই মতামতের সঙ্গে যদি আপনি দ্বিমত প্রকাশ করেন, তাহলে ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছি না।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনব্যবস্থা যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, তাহলেই প্রকৃতভাবে আমাদের অবস্থানটা আমরা জানতে পারব, জনগণও জানতে পারবে। তবে আমরা মনে করি, আমাদের অবস্থান কোথাও খারাপ হয়নি।’
জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক অবস্থান এখন কী- এমন প্রশ্নে মহাসচিব চুন্নু বলেন, ‘কারও সঙ্গে কোনো জোট নেই, কোনো মৈত্রী নেই, কোনো রাজনৈতিক সমঝোতা নেই। জাতীয় পার্টি তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনীতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। সারা দেশে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে আমরা যাব। আমরা জনগণের কাছে এ বার্তা পৌঁছে দেব যে, আগামীতে ক্ষমতায় গেলে আমরা কী করব। একই সঙ্গে আমরা দলকে সংগঠিত করব।’
তিনি বলেন, ‘আগামীতে আমরা ৩০০ আসনে যোগ্য প্রার্থী দেব। সেই প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ করব।’
৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার সক্ষমতা জাতীয় পার্টির রয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সক্ষমতা তো আওয়ামী লীগ ও বিএনপিরও নেই। এ জন্যই তো তারা জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোট করতে চায়। জাতীয় পার্টি কিন্তু জোট করতে চায় না। তার মানে তাদেরও ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়ার কনফিডেন্স নেই।’
দলে ভাঙন-বিভেদ
ক্ষমতা ছাড়ার পর দলের প্রভাবশালী নেতারা প্রধানত বিএনপি এবং পরে একাংশ আওয়ামী লীগে ভেড়ার পাশাপাশি প্রায় একই নামে নতুন দল গঠন করে দুই প্রধান দলের সঙ্গে জোটে ভিড়েছেন।
গত তিন দশকে দল ভেঙেছে অন্তত তিন দফা। এ ছাড়া দলের ভেতর এখন তৈরি হয়েছে নানা বলয়।
১৯৯৯ সালে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জাতীয় পার্টি জোটে গেলে দলে ভাঙন ধরে। বরিশাল অঞ্চলের প্রভাবশালী নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু একই নামে আরেক দল নিয়ে এগোন। ব্র্যাকেটবন্দি এ দলটির নাম জাতীয় পার্টি-জেপি। দলটি আওয়ামী লীগের জোটের শরিক হয় পরে।
মঞ্জুকে দলে ধরে রাখতে না পারার পর এরশাদ নিজেও পরে চারদলীয় জোট ছেড়ে যান। কিন্তু সে সময় দলটির দুই নেতা নাজিউর রহমান মঞ্জুর ও এম এ মতিন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি বা বিজেপি নামে দল গঠন করে থেকে যান চারদলীয় জোটে। আরেকটি শক্তিক্ষয় হয় দলটির।
২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে এরশাদের অংশগ্রহণের ঘোষণায় দলে ঘটে আরেক ভাঙন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ এবার চলে যান এরশাদকে ছেড়ে। গঠন করেন জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর)। তিনি পরে যান ২০ দলীয় জোটে।
দশম সংসদ নির্বাচনে দলটির অংশগ্রহণ নিয়ে নানা নাটকীয়তাও ঘটেছে। এরশাদ ভোটে আসার ঘোষণা দিয়েও একবার বেঁকে বসেন। পরে আইনশঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে ভর্তি করে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। তখন এরশাদপত্নী বেগম রওশন এরশাদ নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
এ নিয়ে দল স্পষ্টত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এরশাদপন্থি ও রওশনপন্থি দুটি উপদলের মধ্যে রওশনপন্থিরা ভোটে গিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসেন। এরশাদ একটি আসন থেকে নির্বাচিত হলেও ভোটে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দেয়া তার অন্য অনুসারীরা জিততে পারেননি।
২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর রওশন অনুসারীরা দলে প্রভাবশালী হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রয়াত সেনাশাসকের ভাই জি এম কাদের হন দলের চেয়ারম্যান। রওশন এখন অসুস্থ, তিনি দেশের বাইরে চিকিৎসাধীন। এই পরিস্থিতিতে দলের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি জি এম কাদেরের হাতেই। যদিও রওশনপন্থি হিসেবে এককালে পরিচিতি পাওয়া মুজিবুল হক চুন্নু এই দলের মহাসচিব এখন।
পরের শক্তিতে বলীয়ান
দল গঠন করার বছরেই হওয়া তৃতীয় জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে দ্বিতীয় অবস্থানে ঠেলে শীর্ষে উঠে আসে নতুন দল জাতীয় পার্টি। ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৫৩টি দখলে যায় তাদের। মোট ভোটের মধ্যে ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ পায় দলটি।
সেই নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। ভোটের ফল নিয়ে তীব্র আপত্তি ছিল আওয়ামী লীগের। তবে ভোটের ফল ঘোষণা হয়ে গেলে আর কিছু করার থাকে না, সেটিই হয়েছে।
দুই বছর পর ১৯৮৮ সালের জাতীয় নির্বাচন বিএনপির মতো বর্জন করে আওয়ামী লীগ ও সমমনারাও। তাতে নির্বাচন আটকে থাকেনি।
একতরফা সেই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির আসন হয় ২৫১টি। মোট ভোটের ৬৮ দশমিক ৪ শতাংশ দেখানো হয় দলের প্রতীক লাঙ্গলে।
তবে এই প্রতাপের অবসান ঘটে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এরশাদের পতনের পর।
১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে পরের তিনটি নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে আসন কমেছে জাতীয় পার্টির। ভোটও হারিয়েছে তারা।
তবে ২০০৮ সাল থেকে পরের তিনটি জাতীয় নির্বাচনে তাদের আসন আবার বাড়ে। এর কারণ নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি নয়, দেশের অন্যতম প্রধান দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ রাজনীতি করা। আর এই সমীকরণে ভোট না বাড়লেও আসন বেড়ে যায়।
১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির আসন কমে হয় ৩৫টি। মোট ভোটারের ১১ দশমিক ৯ শতাংশের সমর্থন যায় তাদের বাক্সে। তবে এই ভোটার আর আসনের সিংহভাগই বৃহত্তর রংপুরের। গত তিন দশকে যে এলাকাগুলোও বলতে গেলে হারিয়েছে ফেলেছে দলটি।
১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির আসন আরও কমে হয় ৩২টি। তবে ভোটের হার কিছুটা বেড়ে হয় ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ।
তবে ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোটের হারে ধস নামে। আসন কমে যায় অনেক। ওই নির্বাচনে দলটির আসন কমে হয় ১৪টি, শতকরা হারে ভোটের হার কমে হয় ৭ দশমিক ২২ শতাংশ।
এই নির্বাচনের দুই বছর আগে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয় জাতীয় পার্টি। তবে ভোটের আগে আগে সে জোট ছেড়ে যান এরশাদ। কিন্তু দলের একটি অংশ বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি নামে দল গঠন করে থেকে যান বিএনপি-জামায়াত জোটে।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ভোটে লড়ে আওয়ামী লীগের শরিক হিসেবে। এই নির্বাচনে ভোটের হার কমে ৭ শতাংশে নামলেও আসন বেড়ে হয়ে যায় ২৭টি। এর প্রতিটিতেই আওয়ামী লীগ প্রার্থী না দিয়ে জাতীয় পার্টিকে সমর্থন দিয়েছিল।
২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। সেই ভোটে আওয়ামী লীগের সমর্থনে জাতীয় পার্টি আসন পায় ৩৪টি। ভোটের শতকরা হার দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৩১ ভাগ।
এই নির্বাচন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি সব আসনে জোটবদ্ধ হয়ে না লড়লেও বিজয়ী জাপা প্রার্থীদের আসনগুলোয় আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেয়নি। যেখানে যেখানে দুই দলেরই প্রার্থী ছিল, তার সবগুলোতেই পরাজয় বরণ করতে হয়েছে জাতীয় পার্টির।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচনে আবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয় জাতীয় পার্টি। এই নির্বাচনে দলটি আসন পায় ২৭টি।
ভোট শেষে আবার ভেঙে দেয়া হয় মহাজোট। এখন জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি।