২০২২ সাল হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের বাঁক বদলের একটি বিশেষ বছর। এই বছরের জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে তিনটি বড় অবকাঠানো চালু হবে।
২০২২ সালে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হবে। একই সময় রাজধানীর উত্তর থেকে দক্ষিণে ছুটবে মেট্রোরেল। দেশের দক্ষিণ-পূর্বের বন্দরনগরী চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশের সুড়ঙ্গপথও চালু হয়ে যাবে তত দিনে। এই টানেল কক্সবাজারের সঙ্গে চট্টগ্রামের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে।
শুরু হবে অবকাঠামো সামর্থ্যে ভিন্ন এক বাংলাদেশের যাত্রা। ২২ বছর আগে ১৯৯৮ সালের জুনে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু চালুর পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক দুর্দান্ত গতি সঞ্চার হয়েছিল। শুরু হয়েছিল এক ভিন্ন বাংলাদেশের যাত্রা।
ওই সেতুর প্রধান ঋণদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক তখন বলেছিল, এটি চালু হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে দশমিক ৬০ শতাংশ অতিরিক্ত গতি পাবে। তবে বাস্তবে দেখা যায়, প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে ১ থেকে দেড় শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি যোগ করে চলেছে বঙ্গবন্ধু সেতু। এ তথ্য বিশ্বব্যাংকসহ স্থানীয় অর্থনীতিবিদরা বারবার দিয়েছেন।
এবার তারা বলছেন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল এবং বঙ্গবন্ধু টানেল চালু হলে কম করে হলেও বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ২ শতাংশ বাড়তি যোগ হবে। আর তাতেই ডাবল ডিজিট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে হাঁটা শুরু করার সুযোগ সৃষ্টি হবে বাংলাদেশের।
এ কারণে নিশ্চিত করেই বলা যায়, ২০২২ সাল হবে বাংলাদেশের আরেকটি বাঁক বদলের (টার্নিং পয়েন্ট) বছর। আর এভাবে এগোতে থাকলে ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ।
ইতিমধ্যে করোনা মহামারির ধকল সামলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। আগে উন্নয়নের যে ধারাবাহিকতা ছিল, সে অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করেছে। আগের মতো ৮ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। তার সঙ্গে যোগ হবে এই স্বপ্নের তিন প্রকল্পের ২ শতাংশ।
২০২৩ সাল থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়নের নতুন অধ্যায় শুরু হবে বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম। অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর এবং ব্যবসায়ী নেতা ফারুক হাসানও মন্ত্রীর সঙ্গে একমত।
পৌনে দুই বছর ধরে চলমান করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে আবার গতি ফেরার পূর্বাভাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার গবেষণা বিভাগ বলেছে, যদি করোনা পরিস্থিতি বর্তমানের পর্যায়েও থাকে, তার পরেও এবার প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে ৬ দশমিক ১০ শতাংশ। আর যদি করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হয়, তাহলে প্রবৃদ্ধি আরও বেড়ে হতে পারে ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশের মতো।
বিশ্বব্যাংক বলছে, এবার প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। আইএমএফ বলেছে, ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হবে। আর এডিবি বলেছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হবে।
এসব পূর্বাভাস সরকারের লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি। এবার সরকার ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগামী বছরের জুনে পদ্মা সেতু, এরপর কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল এবং ডিসেম্বরে এমআরটি-৬ প্রকল্পের আওতায় মেট্রোরেল উদ্বোধন করা হবে।’
ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ২০২১ সালের শেষ দিন শুক্রবার পদ্মা সেতু পরিদর্শন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেছেন, ‘আমরা যদি একটু ঠান্ডা মাথায় হিসাব করি, তা হলে দেখতে পাবো, ২০২২ সালের মধ্যে করোনা পরিস্থিতি যদি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে আসে, আমাদের অর্থনীতি যদি আগের অবস্থায় ফিরে আসে, তাহলে ২০১৯-২০ অর্থবছরের মতো ৮ শতাংশের ওপরে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ফিরে যাবে বাংলাদেশ। তার সঙ্গে এই তিন মেগা প্রকল্পের অর্থনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্য যোগ হলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুই অংকের (ডাবল ডিজিট) মাইলফলকের ঘরে নিয়ে যেতে পারব।
‘তখন আর আমাদের পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। উন্নয়নের উল্লম্ফন অব্যাহত থাকবে। ২০৩১ সালের মধ্যেই উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হব আমরা।’
অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘করোনার ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। রপ্তানি আয় বাড়ছে। আগামী দিনে আরও বাড়বে বলেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকায় করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় আমাদের পোশাক রপ্তানিকারকরা প্রচুর অর্ডার পাচ্ছেন। দামও বেশি পাচ্ছেন আমাদের রপ্তানিকারকরা।
‘রেমিট্যান্সে কিছুটা ধীরগতি থাকলেও আমদানি বাড়ছে। আমদানি বাড়া মানে দেশে বিনিয়োগ বাড়া, অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হওয়া। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়া। রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন ডলারে অবস্থান করছে। সব মিলিয়ে একটা স্বস্তিদায়ক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা।’
তিনি বলেন, ‘আশার কথা হচ্ছে, পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে আগামী বছরেই যানবাহন চলাচল করবে। মেট্রোরেলও পুরোদমে চলতে শুরু করবে। কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজও শেষ হবে। এই তিনটি বড় প্রকল্প বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ভিন্নমাত্রা যোগ করবে।
‘সে পরিস্থিতিতে ২০২৩ সাল থেকে ভিন্ন বাংলাদেশ পাবে দেশবাসী। আর এসব উন্নয়নযজ্ঞকে কেন্দ্র করে বিনিয়োগের ছক কষছেন উদ্যোক্তারা। সে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতেই প্রয়োজনীয় পণ্য-সরঞ্জাম আমদানি করছেন। বাড়ছে আমদানি।’
সবকিছু ঠিকঠাক মতো চললে ২০২৩ সাল থেকে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে আরও মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন আহসান এইচ মনসুর।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সত্যিই সাহস পাচ্ছি আমরা। প্রচুর অর্ডার আসছে। গত অর্থবছরের চেয়েও এবার বেশি হবে রপ্তানি আয়ে।
‘এরই মধ্যে এই তিন মেগা প্রকল্প চালু হলে তার সামগ্রিক প্রভাব রপ্তানি বাণিজ্যসহ অর্থনীতির সব খাতেই পড়বে। ২০২৩ সাল থেকে এক নতুন, ভিন্ন বাংলাদেশ পাব আমরা।’
পদ্মা সেতু
দেশের অবকাঠামো খাত নিয়ে গবেষণা করা অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত নিউজবাংলাকে বলেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পদ্মা সেতুর প্রভাব হবে অপরিসীম। সবচেয়ে বড় কথা হলো সড়কপথ ও রেলপথে যোগাযোগের সময় চার ঘণ্টা কমে যাবে। এতে মানুষের যাতায়াত সহজ হবে। নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠবে।
তিনি বলেন, ‘সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার আগে প্রাক্-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে আমরা অনুমান করেছিলাম, এই সেতু হলে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। তবে এখনকার বাস্তবতা সেই অনুমানের চেয়ে অনেক বেশি। অর্থাৎ অর্থনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির হার এর চেয়েও বেশি হবে। দেশের অর্থনীতি চাঙা হবে, সম্প্রসারিত হবে বাজার। এত দিন সেখানে কৃষিপণ্যের বাজার ছোট ছিল, এখন সেই বাজার বড় হবে। কৃষকরা ঢাকায় ফসল পাঠাতে পারবেন। ধারণা করা যায়, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আয় দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
এই সেতুর কারণে মোংলা বন্দর গতি পাবে। এত দিন এই বন্দর তেমন একটা ব্যবহৃত হতো না। এখন যোগাযোগ গতি পেলে এই বন্দরের ব্যবহার বাড়বে। যোগাযোগ উন্নত হলে স্বাভাবিকভাবে দক্ষিণাঞ্চলে নতুন শিল্পায়ন হবে। অনেক মানুষ কাজ পাবে। বেকারত্ব কমবে, কমবে মানুষের ঢাকায় আসার প্রবণতা।’
প্রত্যাশিত গতিতে এগিয়ে চলছে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজও। ফাইল ছবি/নিউজবাংলা
মেট্রোরেল
মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক যাত্রা দেশবাসীর মধ্যে আশাবাদ এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি করেছে। জাপানের অর্থ ও কারিগরি সহায়তায় ঢাকাবাসীর স্বপ্নের প্রকল্প মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার। রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ছুটে বেড়াবে ট্রেন।
বর্তমানে উত্তরা থেকে মতিঝিলে যেতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু মেট্রোরেলে লাগবে মাত্র ৩৮ মিনিট। এতে প্রতিদিন ৫ লাখ যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকার যানজট যেমন কমবে, তেমনি জিডিপিও ১ শতাংশ বাড়বে। ঢাকার অসহনীয় যানজটে শুধু মানুষের দুর্ভোগই বাড়ছে না, দেশও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বলা হচ্ছে, কর্ণফুলীর তলদেশে টানেলটি চালু হলে বদলে যাবে চিরচেনা চট্টগ্রাম। ফাইল ছবি/নিউজবাংলা
কর্ণফুলীর বঙ্গবন্ধু টানেল
সরকারের জন্য অনেক বেশি গর্ব করার মতো প্রকল্প হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর নিচের সুড়ঙ্গপথ বঙ্গবন্ধু টানেল। এ ধরনের পথ দেশের ইতিহাসে প্রথম। পানির তলায় এই সুড়ঙ্গপথটি কক্সবাজারের সঙ্গে চট্টগ্রামের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে। কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের গাড়ি চট্টগ্রাম শহরকে এড়িয়ে সুড়ঙ্গপথ দিয়েই রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে চলাচল করতে পারবে। তাহলে চট্টগ্রাম নগরীর যানজটও অনেকাংশে কমবে।
১০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ টানেল চীনের সঙ্গে জি-টু-জি ভিত্তিতে নির্মাণ করা হচ্ছে। এ প্রকল্পে চীনা-সহায়তা প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে চীনের একটি প্রতিষ্ঠান।
টানেলটি চালু হলে বদলে যাবে চিরচেনা চট্টগ্রাম। নদী, পাহাড় আর সাগর-মোহনার চট্টগ্রাম পাবে নবরূপ। নদীর ওপাড়ে গড়ে উঠবে আরেক চট্টগ্রাম। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আবাসন ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হবে। চীনের সাংহাই নগরীর মতো চট্টগ্রাম হবে ওয়ান সিটি-টু টাউন। যার প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।