করোনার গণ টিকাদান কর্মসূচিতে সফলতা থাকলেও সরকারিভাবে দেশে নিজস্ব টিকা উৎপাদন উদ্যোগ ঝিমিয়ে পড়ছে। দেশীয় ব্যবস্থাপনায় এই টিকা নভেম্বর-ডিসেম্বরে উৎপদনে যাওয়ার কথা থাকলেও বছর গড়িয়ে এখনও তা আলোর মুখ দেখেনি।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বলছে, সরকারিভাবে টিকা উৎপাদনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। কথা ছিল বিদেশ থেকে বড় পরিমাণ (বাল্ক) টিকা এনে তা ছোট ছোট বোতলে ভরা হবে। আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা: বিদেশি টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং প্রয়োজনে মানবদেহে পরীক্ষার (ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল) মাধ্যমে দেশেই টিকা উৎপাদন। এ সব কাজ শেষ হতে আরও চার থেকে ছয় মাস লেগে যেতে পারে।
এ দিকে চীনের তৈরি সিনোফার্ম টিকা দেশে উৎপাদনের জন্য গত ১৬ আগস্ট বাংলাদেশ এবং চীনের টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং দেশীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী নভেম্বর টিকা উৎপাদনে যাওয়ার কথা থাকলেও সেটা সম্ভব হয়নি। টিকা উৎপাদনে আরও কিছু দিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মুক্তাদির।
আব্দুল মুক্তাদির বলেন, কিছু জটিলতার কারণে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। সেটা হয়তো জুন-জুলাইয়ে হতে পারে।
৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে ডাইয়াটিস ইন্টারন্যাশনাল ইনকরপোরেশনের একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হওয়ার কথা ছিল। তা অনিবার্য কারণে স্থগিত করা হয়েছে।
বছরের প্রথম দিকে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এই ভাইরাস প্রতিরোধে গণটিকা কার্যক্রম শুরু হয় ৮০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনার লক্ষ্য নিয়ে। ইতোমধ্যে ৪১ শতাংশ মানুষের দ্বিতীয় ডোজ সম্পন্ন হয়েছে। স্বাভাবিক টিকাদানের পাশাপাশি চলছে বুস্টার ডোজের কার্যক্রম। মার্চের শেষেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মাধ্যমে। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে ৪ অক্টোবর। এরপর তিন মাস ধরে এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে থাকায় জনগণ স্বস্তিতে ছিল। তবে নতুন ভ্যারিয়েনটট ওমিক্রণ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
গণটিকায় সাফল্য
দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে গত ৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় টিকাদান কর্মসূচি। দেশে ইতোমধ্যে ২০ কোটি টিকা এসেছে। পূর্ণ দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন ৩০ শতাংশ মানুষ। প্রায় ৫০ লাখ মানুষ এখনও নিবন্ধন করা সত্ত্বেও টিকার প্রথম ডোজ পাননি।
বাকিদের টিকার আওতায় আনতে দুই মাস ব্যাপী টিকা ক্যাম্পেইনে চলবে। গ্রামে গ্রামে এই ক্যাম্পেইনে ৩ কোটি ৩ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া হবে।
২১ জানুয়ারি ভারত থেকে দেশে প্রথম টিকা আসে। চুক্তি অনুযায়ী ভারত থেকে ৩ কোটি ডোজ টিকা আসার কথা থাকলে দুই চালান আসার পর ভারতে করোনা পরিস্থিতি বেড়ে যাওয়ায় টিকা দেয়া বন্ধ করে দেয় ভারত। এক পর্যায়ে টিকাদান কর্মসূচি ভীষণ হোঁচট খায়। এ সময় পাশে দাঁড়ায় চীন। দেশে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি এসেছে চীনের সিনোফার্মের টিকা। এ ছাড়া জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশ টিকা দিয়েছে। দেশে চার কোম্পনির টিকা দিয়ে গণটিকা কার্যক্রম চলছে।
সেবা খাতে ব্যবস্থাপনা
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর রোগী শনাক্তে নমুনা পরীক্ষা, হাসপাতাল অবকাঠামো ও গুরুতর রোগীদের জন্য সেন্ট্রাল অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর, আইসিউই সেবার ব্যাপক ঘাটতি ছিল। প্রথম ঢেউয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও ছিল অনেক বেশি। কিন্তু দ্বিতীয় বছরে এ সীমাবদ্ধতা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে স্বাস্থ্যবিভাগ।
বর্তমানে দেশে করোনা রোগীর চিকিৎসায় ১৩ হাজার ৫২৮টি সাধারণ শয্যা, ১ হাজার ২১৯টি আইসিইউ, ৭০৮টি এইচডিইউ বেড ছাড়াও রোগী শনাক্তে আরটি-পিসিআর, জিন-এক্সপার্ট, র্যাপিড এন্টিজেন পরীক্ষায় সরকারি-বেসরকারিভাবে ৮৪৮টি নমুনা পরীক্ষাগার রয়েছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে গত ১০ মাস ধরে টিকা দেওয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মাদ খুরশীদ আলম বলেন, করোনা মোকাবিলায় চিকিৎসা সেবার উন্নয়নে লজিস্টিক সাপোর্ট, জনবল নিয়োগ, অবকঠামোগত উন্নয়ন ও সক্ষমতা অর্জনসহ অনেকগুলো জায়গায় উন্নতি করা হয়েছে। বিশেষ করে হাসপাতাল শাখা, সংক্রামক রোগ ব্যবস্থাপনা, ল্যাবরেটরি শাখা ও পাবলিক হেলথ সেক্টরে গুরুত্বারোপ করায় স্বাস্থ্যখাতে সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
রেকর্ড জনবল নিয়োগ
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার নাজুক পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০১৯ সালে সাড়ে ৪ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়। করোনা সংক্রমণের পর ২০২০ সালের মে মাসে নিয়োগ দেওয়া হয় আরও ২ হাজার চিকিৎসকে। এভাবে ৩৯তম বিশেষ বিসিএস থেকে দুই ধাপে সাড়ে ৬ হাজার নিয়োগ দেওয়া হয়। ৪২তম বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমেও চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া পিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্য থেকে ৪ হাজার নার্স নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই জনবল দিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
মুখে খাওয়ার ওষুধ বাজারে
গত ৮ নভেম্বর করোনার মুখে খাওয়ার প্রথম ওষুধ মলনুপিরাভির অনুমোদন দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। পরদিন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস এই ওষুধটির জেনেরিক সংস্করণ ‘এমোরিভির-২০০’ নামে দেশের বাজারে আনে। পাশাপাশি এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালসের মলনুপিরাভির বাজারে আসে। কিন্তু করোনার প্রকোপ কমে আসায় সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি ওষুধটি।
বুস্টার ডোজ
স্বাভাবিক টিকা কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে করোনা টিকার বুস্টার ডোজ। ৬০ বছরের বেশি বয়সী ও করোনা মোকাবিলায় সম্মুখসারির যোদ্ধাদের দেওয়া হচ্ছে করোনা এই টিকা। ঢাকায় সীমিত পরিসরে এই টিকা দেওয়া হচ্ছে।
তবে জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে হবে। এ পর্যন্ত প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে ৬০ শতাংশ এবং ৩৫ শতাংশ মানুষ দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৪০ ভাগ প্রথম এবং ৬৫ ভাগ মানুষ পূর্ণ দুই ডোজের বাইরে রয়ে গেছে। অন্যদিকে ষাটোর্ধদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ প্রথম এবং ৬০ শতাংশ দ্বিতীয় ডোজের বাইরে রয়ে গেছে। বুস্টার ডোজের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও এমন পরিস্থিতিতে এটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।